নিয়তি || সাবিনা ইয়াসমিন

রাত অনেক গভীর হঠাৎ লামিয়ার ঘুম ভাঙল আর কিছুতেই ঘুম আচ্ছে না দুটি চোখে।
একটা প্রশ্ন, তার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে,
কি অপরাধ ছিল আমার, কিছুই তো বলে গেলে না।
কি ভুল ছিল আমার সেটাও বলে গেলে না, কেন এমনটি করো আমার সাথে।
তোমার সব কথা, সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে নীরবে নিঃস্বার্থভাবে পালন করতাম, কখনো কোনো অভিযোগ করিনি।
নিঃশব্দ মনে সবি তো, সহে নিতাম। নিজের কষ্ট, বেদনা যন্ত্রণাগুলো, মনের নির্জনে লুকিয়ে রাখতাম।
কখনো তোমার সামনে তুলে ধরিনি বা মনের অজান্তেও বুঝতে দেইনি,
তোমাকে খুব ভালবাসি বলে। যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পরতে, শুধু আমাকে আকরে ধরে বাঁচতে চাইতে। আমি কখনো কোনো কারণে দূরে যেতে চাইলে, তুমি অসহায় শিশুর মত কাঁদতে আর তোমার বুকেতে জড়িয়ে বলতে আমি ছাড়া এক মুহূর্ত নাকি চলে না তোমার।
রান্না করতে গিয়ে, একটু হাত পুড়ে গেলে যে কষ্ট যন্ত্রণা আমার হত, তার চেয়ে নাকি তুমিই বেশি কষ্ট পেতে।
একদিন একটি বিশেষ কাজে, আমার বান্ধুবী রীমুর বাসায় গিয়েছিলাম। সেই দিন প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে, আমি সেই রাতে বাসায় আসতে পারিনি।
তুমি নাকি সারা রাত ঘুমাওনি, আমাকে ভেবে ভেবে কেটে গেছে রাতটি তোমার।
তোমার নাকি মনে হচ্ছিল, আমি ছাড়া তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, কাঁদ কাঁদ কন্ঠে সেদিন আমায় বলেছিলে আমি নাকি তোমার অক্সিজেন।
কেউ কাউকে ছাড়া, কখনো ভেবে দেখিনি। আমার হৃদয় জুড়ে শুধু তুমি আর তুমি, আমার সমস্ত হৃদয় তোমাকে টানে, আমার পরে থাকা দীর্ঘশ্বাস তোমাকে টানে। বিশ্বাস করো একটি মুহূর্ত তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না আমার, তুমি শুধু আমার একান্ত আমার।
তবে আজ কেন এত দুরত্ব, বারবার ভাঙছো, এ হৃদয় আমার। সুখের ঘরে দিচ্ছো দুঃখের দহন, তিলে তিলে হচ্ছে, আমাদের ভালবাসার মরণ।
তুমি আমার তা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না।
যখন তোমার মা এসে আমাকে জিজ্ঞাস করে, তুমি কেন আচ্ছো না দেশে ফিরে। হাজারটা প্রশ্ন আমাকে রাখে তখন ঘিরে।
কি উত্তর দেব আমারো তো জানা নেই, সব কষ্ট দূরে রেখে একটু মুশকি হেসে, মাকে বলতাম। ও অনেক ব্যস্ত মা, ছুটি পাচ্ছে না, ছুটি পেলেই দেশে আসবে।
মাকে আমি যতই সান্ত্বনা দেই, নিজেকে পারি না সান্ত্বনা দিতে। ভেতরটা ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
আড়ালে চুপিচুপি কাঁদি, মাকে বুঝতে দেই না। ফোন দাও ঠিকই, তবে ভালো ভাবে কথা বলো না, সব সময় ব্যস্ততা দেখাও। কি এমন ব্যস্ততা তোমার ?
লামিয়ার এ হাজারটা প্রশ্নগুলোর, কোনো উত্তর জানা নেই।
একদিন লামিয়ার শ্বাশুড়ি, অসুস্থ হয়ে পরলে লামিয়া ওর শ্বাশুড়িকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার ছিল লামিয়ার শ্বাশুড়ির পরিচিত। লামিয়ার সাথে ডাক্তারের পরিচয় করিয়ে দিল, রোহানের বেস্ট ফ্রেন্ড সাহেদ। তোমাদের বিয়েতে আসতে পারেনি, দেশের বাইরে ছিল।
সাহেদ তুমি কবে দেশে এসেছ বাবা।
সাহেদ বলল আন্টি প্রায় একমাস তো, হয়ে গেল আমার দেশে আসার।
আন্টি আপনার এ অবস্থা কেন? ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করেন না মনে হয়, কি এত টেনশন করেন আপনি ?
লামিয়া তুমি কি আন্টির দেখা শুনা ঠিক মত করো না নাকি?
লামিয়া বলল দেখি তো, যতক্ষণ বাসায় থাকি, ততক্ষণ মায়ের সেবায় পরে থাকি। আমার তো মা নেই ইনিই আমার আপন মায়ের মত।
আমি অফিস যাওয়ার আগে, মায়ের সমস্ত কাজ করে দিয়ে যাই কোনো কিছুর অভাব রাখি না।
লামিয়া মা আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখে ,আচ্ছা সাহেদ বাবা। তোমার সাথে কি কখনো রোহানের দেখা হয়নি ?
সাহেদ বলল অনেক বার দেখা হয়েছিল, ছুটির দিনে আমরা এক সঙ্গে আড্ডা দিতাম।
লামিয়া শ্বাশুড়ি বলল কি এত ব্যস্ত রোহান দেশে ফিরছে না ?
সাহেদ বলল আমি জানি না আন্টি।
লামিয়ার শ্বাশুড়ি বলল বউমাও আমাকে কি জানি লুকাতে চেষ্টা করে জিজ্ঞাস করলে কিছুই বলে না। নীরবে নির্জনে কাঁদে চোখের অশ্রুগুলো আমার থেকে আড়াল করতে চায়, কিন্তু আমি তো মা সবি বুঝি নিশ্চয়ই ওদের দুজনের মাঝে কিছু একটা হয়েছে।
লামিয়া বলল- মা আপনি চুপ করেন তো, আপনি অসুস্থ বেশি কথা বলেল আবার অসুস্থ হয়ে পরবেন।
সাহেদ বলল- হ্যাঁ আন্টি আপনি অসুস্থ, বেশি কথা বলেল অসুস্থ হয়ে পরবেন, লামিয়া আমি প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছি আন্টিকে সময় মত ট্যাবলেটগুলো খাওয়াবে আর তোমার সাথে একান্ত কিছু কথা আছে।
লামিয়া ওর শ্বাশুড়িকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে আবার সাহেদের চেম্বারে আসল।
বলেন কি বলবেন ?
সাহেদ বলল- লামিয়া, তুমি কি রোহানের ব্যাপারে কিছু জানো না ?
লামিয়া বলল- না জানি না। সাহেদ বলল রোহান কেন দেশে ফিরছে না, তোমাকে কি কিছুই বলেনি ?
লামিয়া বলল- না বলেনি, ও তো আমার সাথে ঠিক মত কথাই বলে না, যদিও বা ফোন করে শুধু ব্যস্ততা দেখায় কি এত কাজ ওর?
আমাকে ফোনে একটু সময় দিতে পারে না।
সাহেদ বলল- লামিয়া তোমার কষ্ট হলেও এটাই সত্যি আর বাস্তবিক, যে রোহান হয়তো দেশে ফিরছে না, ও ঐখানে এক বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করেছে।
ঐ দেশের নাগরিক হয়ে গেছে।
সাহেদের কথাগুলো শুনে, লামিয়া আত্মহারা হয়ে পরল, লামিয়ার মনে হচ্ছিল তার পায়ের নিচের সমস্ত মাটি সরে যাচ্ছে। মাথার উপর থেকে আকাশটা ভেঙে পরছে।
যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন এত কল্পনা।
যাকে আকরে ধরে সারাজীবন বাঁচার কথা, সে দিল এভাবে ব্যাথা! বড় নিষ্ঠুর এ পৃথিবীর মানুষগুলো, অনেক স্বার্থপর।

কি করবে? কি বলবে? কোনো কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না লামিয়া। ওর সব আশা ভালোবাসা, রোহানের উপর ভরসা, এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল। যার জন্য এত অপেক্ষা, ক্যালেন্ডরের পাতা দাগে দাগে কেটে যাওয়া দিন। সে নাকি আসবে না আর কোনো দিন!