৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলাম

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি ভাষা সৈনিক ঠাকুরগাঁওয়ের দবিরুল ইসলাম।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের এক সাহসী নাম ছিলো দবিরুল ইসলাম। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে যার সত্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বে যে ক’জন সাহসী সূর্য সন্তান তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল দবিরুল ইসলাম ছিলেন সেই সাহসী, স্বপ্ন সারথিদের অন্যতম। তৎকালীন সময়ে অনলবর্ষী বক্তা হিসেবেও তরুণ ছাত্রনেতা দবিরুলের খ্যাতি ছিল চারদিকে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের নায্য আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন এ সবের পিছনে অসামান্য অবদান রেখেছেন ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলাম। ছাত্রবস্থাতেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখা শুরু করেন। লাহিড়ী এম.ই হাই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজশাহী বিভাগীয় ‘মায়াদেবী উম্মুক্ত রচনা প্রতিযোগীতায়’ লাভ করেন স্বর্ণ পদক। এরপর ১৯৩৮ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারী কলেজে। এখান থেকে আই.এ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।

তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাবে ইতিহাসের স্মৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাই ভাষা সাংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী এই সৈনিকের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে স্বীকৃতির পাশাপাশি পাঠ্য বইয়ে তার জীবন-দর্শন অন্তর্ভূক্ত করার দাবি উঠেছে তার পরিবার ও এলাকাসীর পক্ষ থেকে।

জানা যায়, যাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সেদিন বেগবান হয়েছিল ছাত্রলীগের কেদ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৪৯-১৯৫৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আইন বিভাগের ছাত্র, সাবেক এমএলএ, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (যুক্তফ্রন্ট) ও ভাষা সৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম তাদেরই একজন।

ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেফতার হলে তখনও তার উপর ব্যাপক নির্যাতন চলে। জেল থেকে বেরিয়ে ৫৪`র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। কিন্তু কারাগারে নির্যাতনের কারণে তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন।ফলে পরবর্তীকালে এই রোগে ভূগেই তিনি ১৯৬১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বালিয়াড়াঙ্গি উপজেলার পাড়িয়া গ্রাম। এখানে ঘুমিয়ে আছেন ভাষা সৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম।ছাত্রলীগের কেদ্রীয় কমিটির সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ঠাকুরগাঁওয়ের ভাষা সৈনিক মরহুম অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলাম এখন শুধুই ইতিহাস।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাকে ৫২`র ভাষা আন্দোলনের সময় এই গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে দিনাজপুর জেলা কারাগারে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।

এদিকে অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে ঠাকুরগাঁও শহরের কালিবাড়িস্থ সাধারণ পাঠাগার চত্বরে তার স্মৃতিস্তম্ভটি। ওই স্থানটি এখন গোচারণ ভূমি আর সৌচাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতি ভুলতে বসেছে তার আবদানের কথা। তবে কিছুদিন আগে স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কার করেছে উপজেলা প্রশাসন।
কীর্তিমান এ রাজনীতিবীদের জীবন সম্পর্কে ঠাকুরগাঁও জেলার ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আকবর হোসেন বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দবিরুল ইসলামের সঙ্গে আরও অনেকে কারাবন্দী হন। দিনাজপুর কারাগারে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এতে তার হার্টের একটি ভাল্ব নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে ধুকে ধুকে মারা যান তিনি। ’

ভাষা সৈনিকের ছেলে বুলবুল আহম্মেদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘ষাট বছর পরেও জাতীয়ভাবে বাবাকে (দবিরুল ইসলাম) মূল্যায়ন করা হয়নি। সরকারি উদ্যোগে তার স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যা কিছু করা হয়েছে তার সব কিছুই পারিবারিক প্রচেষ্টায়।

ভাষা সৈনিক এর পরিবারের সদস্যরা চান তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হোক এবং তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যাতে নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলন এবং এসব ঘটনা জানতে পারে। ’

দবিরুলের স্ত্রী আবেদা ইসলাম জানান, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার স্বামীর ভালো সম্পর্ক ছিল। এখন পর্যন্ত তার স্বামীকে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।

তিনি বর্তমান সরকারের কাছে কিছুই চান না। শুধু তার স্বামীর রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন চান।

লাহিড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান জানান, দবিরুল ইসলামের জীবন দর্শন, ভাষার জন্য অবদানের কথা নতুন প্রজন্মকে জানাতে তার জীবনী পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্ত করা হলে নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি মরেও বেঁচে থাকবেন।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, বিগত কয়েক বছর আগে মরহুম দবিরুল ইসলামকে সম্মাননা প্রদান করেছেন জেলা প্রশাসন। এছাড়া ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলামের স্মৃতিস্তম্ভ আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। তার জীবনী পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখবেন বলে জানান তিনি।

ভাষা সৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, জীবন সংগ্রাম জাতীয় পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভূক্তিকরণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে জানাতে সরকার উদ্যোগ নেবে এ দাবি ঠাকুরগাঁওবাসীরও।