প্রচারে ঝড় তুলেছেন মাহি,রাব্বানীর সঙ্গে পুরোনো লড়াই ফারুকের

মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও তাকে নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা ছিল না; কিন্তু প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর ভোটের মাঠে দাপটের সঙ্গে প্রচারণা চালাচ্ছেন ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা শারমিন আক্তার মাহিয়া মাহি।

এলাকার ভোটাররা বলছেন, দ্রুত ভোট বাড়ছে অভিনেত্রীর। আর মাহির কারণে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে জমজমাট হয়ে উঠেছে ভোটের প্রচারণা। মাহি রীতিমতো ঝড় তুলেছেন প্রচার-প্রচারণায়। প্রচারের ধরন ও প্রচার সভাগুলোতে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণের কারণে এখন মাহিকেই এ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় সর্বত্রই ঝড় তুলছেন ঢাকাই সিনেমার নায়িকা মাহিয়া মাহি। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীকে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন নৌকার বিরুদ্ধে। শেষ মুহূর্তে ভোটের মাঠে নেমেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সহধর্মিণী আয়েশা আখতার জাহান ডালিয়া। ভোটের মাঠ গরম করছেন এ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী। তিনিও আওয়ামী লীগ নেতা।

ফলে রাজশাহী-১ আসনে ত্রিমুখী সংকট ভাবাচ্ছে ফারুক চৌধুরীকে। এ আসনে দুই নারীসহ মোট প্রার্থী ১১ জন। এর মধ্যে পাঁচজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় মানুষের ব্যাপক সাড়া দেখার পরও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকেই পাত্তা দিচ্ছেন না ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি। তিনি প্রচার সভাগুলোতে বলছেন, ‘এলাকায় গত ১৫ বছরে যে উন্নয়ন করেছি তা এলাকার মানুষই বলবে। আমি এলাকার চেহারা বদলে দিয়েছি। যারা আবোল-তাবোল বকছে বকুক। কোনো সমস্যা নেই। আমি কারো বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি আবারো জিতব। কেউ নায়িকা হোক আর গায়িকা হোক।

অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি অংশ অভিযোগে বলছেন, ফারুকের স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে চরম ক্ষুব্ধ দলের ত্যাগী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে দলের ভেতরেও তীব্র কোন্দল চরমে। স্বৈরাচারী কায়দায় দল পরিচালনা করেছেন ফারুক। কমিটি গঠন করেছেন বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা লোকদেরই প্রাধান্য দিয়ে। ফারুকের দমননীতিতে টিকতে পারেননি আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও।

রাজশাহী-১ আসনে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রধান গোলাম রাব্বানী। রাব্বানী তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। এর বাইরে প্রার্থী হয়েছেন দেওপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান আকতার, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সহধর্মিণী আয়েশা আখতার ডালিয়া এবং চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।

তারা সবাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। দলের মনোনয়ন না পেয়ে ফারুককে ঠেকাতে নিজেরাই প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ছোট ছোট দলের আরও ৬ জন প্রার্থীকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে ফারুক চৌধুরীকে।

এদিকে এবারের ভোটযুদ্ধে এলাকায় সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এখন চিত্রনায়িকা মাহি। প্রচার-প্রচারণায় সবার চেয়ে এগিয়ে। প্রতিদিনই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় তিনি গণসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন। ট্রাক প্রতীক হাতে নিয়ে পায়ে হেঁটে নিজেই বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। নারী ভোটারদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন। কোলাকুলি করছেন।

পর্দার নায়িকাকে হাতের নাগালে পেয়ে উচ্ছ্বসিত এলাকার নারীরা। কাছে পেয়ে সেলফি তুলছেন। কেবল নারীরাই নয়, মাহির প্রচারণায় এগিয়ে আসছেন পুরুষ ভোটাররাও। তার পথসভাগুলোতে উপস্থিত লোকজন হাততালি দিয়ে বেশ সাড়া দিচ্ছেন। সমর্থন পাচ্ছেন নানা শ্রেণি ও পেশার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এ এলাকায় বিশেষ করে সাঁওতাল ও হিন্দুদের সমর্থন পাচ্ছেন মাহি।

জানা গেছে, গত সোমবার গোদাগাড়ী উপজেলার বালিয়াঘাটা কুমারপাড়া গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উলুধ্বনি দিয়ে লাল বেনারসি শাড়িতে জড়িয়ে বরণ করে নেন মাহিয়া মাহিকে। সঙ্গে মাহির স্বামী রকিব সরকারকে ধুতি জড়িয়ে বরণ করেন তারা। এদিন কাঁকনহাটের সুরশুনিপাড়া প্রভু নিবেদন ধর্মপল্লী গির্জায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বড় দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন মাহি। বড়দিনের অনুষ্ঠানে নেচে-গেয়ে তাদের সঙ্গে উৎসবে শামিল হন।

এভাবে মাহি যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই মানুষের ঢল নামছে। এলাকার উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। বলছেন, গেল ১৫ বছরে নানা বঞ্চনার কথাও। ভোটের মাঠে নেমে প্রায় প্রতিদিনই ফারুক চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করছেন মাহি। ফলে ফারুকবিরোধী ভোটাররা মাহির দিকে ঝুঁকছেন।

তিনি বিভিন্ন পথসভায় ফারুক চৌধুরী এমপিকে লক্ষ্য করে বলছেন, সিনেমায় যেমন চৌধুরী সাহেবরা অহংকারী হয়, মানুষকে শোষণ করে শাসন করে- তাকে দেখে মেহনতি মানুষ সামনেও যেতে পারে না। গোদাগাড়ী-তানোরে বাস্তবে সেটার প্রমাণ পাচ্ছি। এখন ভোটের মাঠে এখন আমি সেই চৌধুরীকেই দেখছি। পর্দার চৌধুরীরা যেমন নায়ক-নায়িকার কাছে পরাজিত হয়, তানোর গোদাগাড়ীতেও তাই হবে।

মাহি আরও বলেন, তানোর-গোদাগাড়ীর মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শিক্ষক ফারুক চৌধুরীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিনি শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করান। শিক্ষককে মারেন। তিনি এতো বড় জমিদার স্টাইলে চলেন; কিন্তু জনগণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। ভয়ে পারে না। কেন একটি মানুষকে সবাই এত ভয় পায় তা আমরা বুঝি। চৌধুরী এসি রুমে বসে থাকবেন আর মানুষকে শাসন করবেন, আর ওখান থেকে ভয় দেখাবেন। আমি এখানে এসেছি কারণ, এই জমিদারি প্রথার অবসান করতে। আগামী ৭ জানুয়ারি চৌধুরী সাহেবকে কান্দাইতে হবে। আপনারা তৈরি থাকুন।

অন্যদিকে এ আসনে ফারুক চৌধুরী এমপির সঙ্গে পুরোনো বিরোধের হিসাব মেটাতে চান আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম রাব্বানী। চৌধুরীবিরোধী নেতাকর্মীদের তিনি সংগঠিত করেছেন এলাকায়। দীর্ঘদিন মাঠে আছেন।

এক সময় ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা ছিল সবার মুখে মুখে; কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। কাঁচি প্রতীকে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করছেন।

ফারুক চৌধুরীর উদ্দেশে গোলাম রাব্বানী বলেন, নির্বাচন এলেই তিনি বলে বেড়ান ভোট দিক আর না দিক আমি পাশ। চৌধুরী সাহেব লাঠিয়াল বাহিনীর ভয় দেখান। বলেন লাঠি খেলা হবে ভোটের মাঠে; কিন্তু সাধারণ মানুষ আর অত্যাচারী জনপ্রতিনিধিকে চায় না। তারা সবাই এর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।

এদিকে আইনি লড়াই শেষে গত রোববার প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন আয়েশা আখতার ডালিয়া। তার প্রতীক বেলুন। তিনি গেল দুবছর ধরেই এলাকায় আছেন। ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। শেষ মুহূর্তে ভোটারদের মন জয়ে দিনরাত ছুটছেন। ডালিয়া বলেন, জনগণ আমাকে চায়, আর আমিও তাদের পাশে থাকতে চাই।

এ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান আকতার। তার প্রতীক ঈগল। তিনিও ফারুক চৌধুরীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। দেওপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। ফারুক চৌধুরীকে ঠেকাতে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে ঘুরছেন।

তিনি বলেন, গোদাগাড়ী-তানোরের মানুষ পরিবর্তন চায়। তারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত। সেই জায়গা থেকে দলমত নির্বিশেষে সবাই আগামী ৭ তারিখে আমার প্রতীকে ভোট দেবেন সেই আশা তারা আমাকে দিয়েছেন।