ভেজাল হ্যালোথেনে তিন শিশুর মৃত্যু

গত তিন মাসে অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করে অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়ার পর দেশব্যাপী ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এসব মৃত্যুর কারণও ভেজাল চেতনানাশক হতে পারে। বাজারে নকল বা ভেজাল চেতনানাশক ‘হ্যালোথেন’ রয়েছে। অ্যানেসথেসিয়ায় ভেজাল হ্যালোথেন ডেকে আনছে বিপদ। সমস্যা সমাধানে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে ইনহেলেশন অ্যানেসথেটিক হিসেবে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

৩১ মার্চ অ্যানেসথেসিয়াজনিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আটটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাক্ষরিত এ আদেশ জারি করা হয়। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে মোট হ্যালোথেন/ আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ডেপোরাইজারের সংখ্যা হিসাব করে এ তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখায় ১৫ দিনের মধ্যে পাঠাতে হবে।

সরকারি হাসপাতালে থাকা হ্যালোথেন ভেপোরাইজার পরিবর্তন করে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজার স্থাপনে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রাক্কলন করতে হবে এবং চাহিদা মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের নিয়ে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন ব্যবহার বিষয়ে জানাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন অ্যানেসথেসিয়া মেশিন কেনার ক্ষেত্রে স্পেসিফিকেশন নির্ধারণে স্পষ্টভাবে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুয়েন ভেপোরাইজারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করাসহ আরও বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ ধরনের মৃত্যু বাড়ার জন্য চিকিৎসকরা বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন। এর মধ্যে রয়েছে অ্যানেসথেসিয়ার জন্য আগে বহুল ব্যবহৃত ওষুধ হ্যালোথেন উৎপাদন বন্ধ হওয়া এবং বাজারে নকল হ্যালোথেনের উপস্থিতি। অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেসথেসিয়ার জন্য ব্যবহৃত ব্যয়সাশ্রয়ী ওষুধ হ্যালোথেনের ক্ষতিকর শারীরিক ও পরিবেশগত প্রভাবের কারণে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এটি নিষিদ্ধ করেছে।

দেশে হ্যালোসিন ব্র্যান্ড নাম দিয়ে হ্যালোথেন উৎপাদন করত এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস। গত বছর বাংলাদেশে এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে কিছু হাসপাতালে হ্যালোথেন মজুত ছিল। মজুত কমে যাওয়ায় ঘাটতি মেটানোর চাহিদায় নকল হ্যালোথেন দেশের বাজারে ঢোকার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বাজারে ভেজাল হ্যালোথেনেরও দেখা মিলেছে।

চার মাসের ব্যবধানে বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের বয়স পাঁচ বছরের কম। তারা ছিল শ্রবণপ্রতিবন্ধী। বিএসএমএমইউ সূত্র জানিয়েছেন, শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের শ্রবণসহায়তায় কানে বিশেষ যন্ত্র ‘কক্লিয়ার’ স্থাপন করা হয়। শিশুদের সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার পর কানে কক্লিয়ার বসানো বা স্থাপন করা হয়। এ তিন শিশুকেও কক্লিয়ার স্থাপনের আগে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে হ্যালোথেন দেওয়া হয়েছিল। তাদের একজন মারা গেছে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর, এরপর একজন ১০ জানুয়ারি এবং শেষ জন ৩০ জানুয়ারি।

এ বিভাগের অধ্যাপক সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি দেবব্রত বণিক বলেন, ‘কক্লিয়ার স্থাপন করার সময় অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তিনটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় আমরা সায়েন্সল্যাবে হ্যালোথেন পরীক্ষার জন্য পাঠাই। পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায় ওষুধে ভেজাল ছিল। হ্যালোথেনের পরিবর্তে সেখানে ৫৮টি অন্য উপাদান পাওয়া গেছে। তাই আমরা সুপারিশ করেছি এখন যেন কোথাও হ্যালোথেন ব্যবহার না করে। অনেকের কাছে হয়তো আসল হ্যালোথেন আছে তার পরও সেসব আর ব্যবহার না করাই ভালো। আইসোপ্রন ব্যবহারের বিষয়ে আমরা প্রতিদিন অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের ট্রেনিং দিচ্ছি।’ গত বছরের এপ্রিল থেকে বিএসএমএমইউতে হ্যালোথেন ব্যবহার করা হয় না বলে জানান তিনি। তবে কক্লিয়ার স্থাপন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রজেক্টের আওতায় করা হয়, সে প্রজেক্টের আওতায় হ্যালোথেন কেনা ছিল বলে ব্যবহার করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সম্প্রতি বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানদের এ সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান ও সমাধানের জন্য সুপারিশ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে হ্যালোথেনের ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প ওষুধ ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।