শৈশবের ঈদ, ভোলা যায় না

ঈদ মানে খুশি। আর সেটি যদি হয় ঈদুল ফিতর তহলেতো আর কথাই নেই। আনন্দ আর খুশীর মাত্রা অনেক গূণ বেড়ে যায়। মনে পড়ে তের বছর বয়সে সর্ব প্রথম সবগুলো রোজা রেখেছিলাম। সে বছরের রমজানও ছিল জুন মাসে। এমনিতেই দিন অনেক বড় তার উপর আবার পুরো ত্রি-শটি রোজা রাখা চাট্টিখানা কথা নয়। সে বছরই ঈদের প্রকৃত আনন্দ পেয়েছিলাম। তাই সেটি এখনও আমার জীবনের সেরা ঈদ হিসাবে স্মৃতির মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আমি গ্রামে ছিলাম ( এর আগেই অবশ্য খুলনার “সাপ্তাহিক গ্রামাঞ্চল ” পত্রিকার মাধ্যমে বড় ভাই মনির মোল্লার পৃষ্ঠপোষকতায় সাংবাদিকতার হাতে খড়ি হয়) । তাই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে গ্রামে। তাও দেবিদ্ধার থানা সদরের বা উপশহরের নাম নয় থানা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের রাজনৈতিকভাবে বিখ্যাত এলাহাবাদ গ্রাম। স্মৃতি যত হাতড়ে বেড়াই দেবিদ্ধারের দ্বিতীয় বৃহত্তম সে গ্রামের শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে। আমাদের পরিবার ছিল যৌথ পরিবার। বাবারা ছিল দু ভাই। তখন দাদা- দাদীও বেঁচে ছিলেন। আমার বড়বাবা জয়নুল আবেদীন মিয়াজি ছিলেন একজন বিখ্যাত ঈমাম।তাই পরিবারে ধর্মীয় পরিবেশ বিদ্যমান ছিল।এখনও আমরা যৌথ পরিবারে আছি, তবে মা-জ্যাঠীরা একত্রে নেই একত্রে রয়েছি আমরা ছয় ভাই বোন। আমার জানামতে এলাহাবাদের যৌথ পরিবারগুলোর মধ্যে আমাদের পরিবারটিই অন্যতম। ২৫ জনের পুরো টিমটি যখন একাত্তরের ( মুক্তিযোদ্ধাদের) অস্থায়ী ক্যাম্প নামে পরিচিত মোল্লা বাড়িতে ঈদের আগের দিন গিয়ে হাজির হই তখন পুরো এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়।পরের দিন এসে হাজির হয় আমার বোনের ছেলে,ছেলে বউ, মেয়ে মেয়ের জামাই ও তাদের উত্তরাধিকাররা অরো ১০ জন। কয়েকটি দিন নতুন প্রজন্মেও ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়–য়া সায়িফ, মেডিকেল কলেজে পড়–য়া স¦র্ণা, মাহি, তাজিম থেকে শুরু করে আমার ছোট্ট মেয়ে নিশাতও আনন্দের সাথে হই-হুল্লোর করে দিন কাটায়। বউদের মধ্যে নাজমা, ফাতেমা , শিল্পি, তাহমিনা ও রুজিনাও ঈদের আনন্দ থেকে বি ত হয় না। আমার প্রায় ৯০ বছর বয়সী বাবা আব্দুস সাত্তার মাস্টার প্রপৌত্র আব্দুল্লাহসহ সবাইকে পেয়ে যেন সকল জড়তা কাটিয়ে মানসিকভাবে নতুন করে জেগে উঠেন।সবাই তার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে ধন্য হন। ভাই ভাবীরা মিলে ৭ জন মাস্টার ডিগ্রি পাশ বিদ্ধান এবং উচ্চ শিক্ষায় রত নতুন প্রজন্ম খাবার টেবিলে বসলে ছোট-খাট একটি শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ক সেমিনারে পরিনত হয়।
আমাদের সময় রোজার মধ্যে স্কুলে কোন ক্লাশ হতো না। রোজার মধ্যে কোন ক্লাশ হতো না। তাই ছুটির অঅগের দিনের ক্লাশটা ছিল বন্ধুদেও সাথে ভাব বিনিময়ের দিন। তখন প্রায় ১০ টি গ্রামের ছেলে- মেয়েরা (অধ্যাপক মোজাফ্ফর অধহমেদেও শ্রদ্ধেয় বাবা কেয়ামুদ্দীন মাস্টার প্রতিষ্ঠিত) এলাহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া কতো। ১ মাস লেখাপড়ার তেমন কোন চাপ থাকবে না ভেবে মনে মনে পুলকিত হতাম। তবে ছুটির ?অঅগে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে বন্ধকালীন সময়ের হোম টাস্ক দিয়ে দিতেন। খেলা-ধুলা করলে ক্ষিধা বেশি লাগে একথাটি জানার পরও রমজানের ছুটিতে বল খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। তষনও ক্রিকেট খেলা অধমাদেও গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। স্কুলের খেলায় গেম টিচার অধনসার স্যারের পাশাপাশি জনাব চাঁন মিঞা স্যার উৎসাহ দিয়ে ইন্টা স্কুল খেলায় দলকে জেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। বাড়িওে খেলায় উঃসাহ যোগাতেন সেসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে পড় াছাত্র মফিজ কাকা (যিনি সামপ্রতিককালে ভিক্টারিয় বিশ্ববিদ্যায় কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালনকারীন সময়ে ইন্তেকাল করেন)। তখন এশটি চামড়ার বলেল দাম ছিল অধমাদেও নাগালের বাইরে। তাই পাড়ার সকল ছেলে মিলে এশটি বল কিনেছিলাম্ । খেলার সময় প্রায়ই অফসাইড সংক্রান্ত গোল জটিলতায় ছোট-খাট ঝসড়া লেগে যেতাম। কোন সমাধান করা না গেলে বলতাম বারোজন মিলে বল কিনেছি , তাতে অঅছে ১২ টি কারেঅ ও সাদা চামড়া ।্ আমার বেশি কিছ প্রয়োজন নেই এশটি কালো চামড়াই অধমাকে দিয়ে দাওঅ তোমাদেও সাথে আর খেলবো না। তখন সবাই বলত বল কাটাকাটির দরকার নেই চল আবার অধমরা নতুন কওে খেলা শুরু করি।
তখন অধমাদেও গ্রামে মাইক ছিলনা। সেহরীরি সময় ভাঙ্গা টিনে অঅঘাত কওে কিংবা টিন দিয়ে মাইকের হর্নেও মত বানিয়ে তা দিয়ে যুবক ছেলেরা গজল গাইয়ে মুসলমানদেও জাগাতেন। এয়াড়া দশ কিলোমিটার দূওে অবস্তিত হাবিবুর রহমান জুট মিল থেকে সাইরেন বাজানো হতো। মোট ৩টি সাইরেন দেয়া হতো। প্রথম সাইরেন শুনে মা-চাচীরা ঘুম থেকে উঠে ভাত রান্না করতেন। আরেকটি দিলে আমাদেরকে ডেকে উঠাতেন। তৃতীয় সাইরেন দেয়ার পর মুয়াজ্জিনগণ খালি মুখে আযান দিতেন। গ্রামে ঘড়ির প্রচলন তেমন এশটি ছিলনা। শুনেছি শ্রীপরের অধব্দুর রইফ ডাক্তারের নিকট এশটি ঘড়ি ছিল( ১৯৪৬ সালে কেনা) । সেটি ৪ কিলোমিটার দূরের ধামতী কামিল মাদ্রাসার দপ্তরী সেটি প্রতিদিন নিয়ে যেত এবং সেটি দেখে ঘন্টা দিয়ে আবার সেটি তার ঘওে ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে যখন একটা –অধধটা ( দুপুর পর্যন্ত) রোযা রাখা শুরু করেছি তখন একটু পর পর অঅকাশের দিকে তাকাতাম। ভাবতাম সেটা কতই না অলস যেন নড়তেঅই চায় না। পশ্চিমাকাশে লাল সূর্যটা ডুবেছে কিনা তা দেখার জন্য আমার অবসাপ্রাপত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক অধলী আশ্রাফ মাস্টার অধমাদেও ঘরের পাশে বসে থাকতেন ওনার এলামিং শুনেই অধমরা ইফতার করতাম। অধাকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এলাহাবাদ পশ্চিম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘন্টাটি ইফতারের সময় বাজানো হতো। মাইক অধসার পরও কোন এলাকায় মাইকের সামনে ঘন্টা বাজিয়ে অনেক দূরের লোকদেরকে ইফতারের সময়টি জানিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা চালু ছিল। তখন গ্রামে মুড়ি ভাজার প্রচলন ছিল। প্রত্যক কিষানী রোজার প্রস্তৃতি হিসাবে মৃড়ি এবয় চিড়ার ব্যবস্থা কওে রাখতেন। তাই ইফতাওে সময় কাাঁঠাল- খ্ই, গুঢ়-মুড়ি, দই-চিড়া, অথবা ঘওে বাননো ডালের বড়া দিয়ে লাল আটার পিঠা খেতেন। মুরুব্বীরা পান্তা ভাত খেতেন, কেউ চিড়া ভিজিয়ে ুচুন মিশিয়ে খেতেন, কোন কোন মুরব্বী বলতেন আমার এত কিছুর দরকার নেই আামাকে কাঁ ভাত দাও খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়ে থাকি। পনীয় হিসেবে লেবুর শরবত খেতেন । অধমার মনে পড়ে অধমি যেদিন প্রথম রোজা রাখি সেদিন পাকিস্তান অধমলের ( যদিও ততক্ষণে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে) ৩টি লাল রঙের ১০ পয়সা দিয়ে ৩টি দুধ মলাই অধসক্রিম কিনে রেখেছিলাম ইফতারীতে খাওয়ার জন্য কিন্তু ইফতারীরি আগেই সেটি ঘলে গিয়েছিল। তাই খেয়ে মজা পাইনি।
শৈবের ঈদেও স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করে। কবি বলেছেন- স্মৃতি বড় জ্বালাময়, স্মৃতির পাখিরা গুণ গূন কওে গান গায়, হৃদয়ের সাজানো বাগিচায়। শৈবের ঈদ ছিল একেবারেই আলাদা। অঅজ সমৃতিতে ভাসে কত আপনজনের মুখ। অঅজ অনেকেই অধর বেঁচে নেই। ( অধল্লাহ তাদেরকে বেহেস্ত নসিব করুন)। সেসময় রেডিমেইড র্শাট – প্যান্ট পাওয়া ওযত না। বাজার থেকে গজ কাপড় কিনে ( বাজার ছিল শুধুমাত্র কংশনগর, মোহনপুর , গঙ্গামন্ডল কিংবা দেবিদ্ধাওে, এলাহাবাদেও সামান্য কিছু মালামাল পাওয়া যেত)দর্জিও দোকান থেকে নির্দিষ্ট মাপে তা বানিয়ে নেয়া হতো। তবে চাঁন মিঞা খলিফার দোকানে কাপড়ও পাওয়া যেত। অধব্বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরি করতেন তষনও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরকারি হয়নি। তাই বন্ধু-বান্ধবরা নতুন কাপড় কিনে ফে।েলও অধমরা প্রতি বছর নতুন কাপড় পেতাম না। পুরনো জামা কাপড় থোয়াও ছিল জটিল কাজ। দাদী পুরাতন হালকা কাথা কিংবা মমারী পরিষ্কার করতো কলাগাছের বাকল পোড়ানো ছাই কিংবা, শিমুল তুলঅর ফুলে পোড়ানো ছাইয়ের মাধ্যমে। যাক যে বছর নতুন জামা বানানো হতো সে বছর অধমি চাইতাম ললাল রঙ্গেও পায়জামা ,পাঞ্জাবী , অধল লাল টুপি বানাতে কিন্তু অধব্বা লাল টুপি বানিয়ে দিতেন না। কারণ তখন এলাহাবাদেও প্রাপ্ত বয়স্ক লোকেরাই লাল টুপি( রাশিয়া বা মস্কো প্রভাবিত অধ্যাপক মোজফ্পর অধহমদেও কুঢ়েঘর মার্কা ন্যাপ পার্টিও আদর্শ অনুযায়ী) মাথায় দিত। এশারণে এষনও এশটি কথা বাইরের গ্রামে প্রচলিত রয়েছে “ লাল টুপি দেখলেই মনে হয় ইলাবাজের( এলাবাদ নামের মৌখিক রুপ) জামাই।”১০০০০ জনসংখ্যা অধুষিত এ গ্রামের যুবকেরা দেবিদ্ধারের ২০০টি গ্রামেই কম- বেশি আত্মীয়তা করেছে। অধমরাও লাল টুপি পেতাম তবে এর জন্য ঈদেও আগের শুক্রবার অথবা মঙ্গলবারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। টুপি কেনার জন্য আমি এবং আমার বড় ভাই মনিরকে ( বর্তমানে ব্রাহ্মনপাড়া বগবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক) নিয়ে ্এলাহাবাদ বাজাওে জোড়া বটগাছতলায় চলে যেতাম। সেখানে ্এক ধরণের শক্ত কাগজে ঈদ মোবারক লেখা বিভিন্ন রঙের টুপি পাওয়া যেত। আমি লাল রঙের টুযপই পছন্দ করতাম। ফিরে আসার সময় ছোট ভাই আমিনুলের (ব্যবসায়ী) জন্য একটি টুপি নিয়ে আসতাম।
আমাদের সময় ঈদের চাঁদ দেখা ছিল একটি আনন্দের ব্যাপার। তখন মাইকের প্রচলন তেমন ছিল না। আমাদের বাড়িতে রেডিও ছিলনা। পাশের বাড়ির সামাদ কাকার ঘরে একটি রেডিও ছিল সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ খবর আমরা পেতাম। মেঘমুক্ত আকাশ হলে চাঁদ দেখার জন্য শেষ রোজার ইফতারী করেই বাড়ির পশ্চিম দিকের মাঠে চলে যেতাম। চাঁদ দেখতে পেলে আনন্দে হৈ – চৈ করে সবাইকে জানিয়ে দিতাম। কেউ কেউ পটকা ফাটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করত। গ্রামের লোকেরা রোজার ১৫ পার হলেই মা চাচীরা ঈদের প্রস্তুতি নিতেন। ঈদের দিনে ম্যানু কি হবে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন আমার জ্যাঠা মরহুম আলী আশরাফ মাস্টার। অর এ পরামর্শ কার্যকর করতেন আমার বড় ভাই জনাব সফিক ( বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জ বদিউল অধলম ডিগ্রি কলেজের গণিত বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক ) । তখন ফার্মের মুরগী ছিলনা। তাই আমি অনেক আগে থেকেই মোরগ পুষতাম ঈদুল ফিতরের জন্য। সকালে সেটিই জবাই করতাম। বড় বোন জনাবা লৎফা বেগমের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি সব সময় আম্মার কাজে সহযোগীতা করতাম। সারা বছর ফজরের নামাজ পড়লেও ঈদের দিন মিস হয়ে যেত। আমার শ্রদ্ধেয় মা ( রাফিয়া বেগম, যিনি ২০১৫ সালে ইন্তেকাল করেন) সকালে সবাইকে ডাকাডাকি করে উঠাতেন। বলতেন সবাই গোসল করে আস। তখন গ্রামে মাত্র কয়েকটি টিউবওয়েল ছিল তাই প্রত্যেকে পুকুরে ( চৈত্র মাসে এলাকার কোন পুকুরে পানি না থাকলেও ডিলার বাড়ির পুকুরে থাকত) গিয়ে গোসল করে আসতাম। ইরি বোরোর মৌসুম হলে কেউ কেউ সমিতির গভীর নলকুপে গিয়ে গোসল করে আসত। তখন সেমাই চিনির প্রচলন ছিলনা। মায়ের হাতে পাকানো ছড়ার শির্নি ( গুড়ের মাধ্যমে তৈরি) , পায়েস খেয়ে আমরা ঈদগাহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতাম। আমরা সুজাত আলী নায়বের বাড়ির পাশের ঈদগাহে যেতাম (আমাদের গ্রামে বর্তমানে মহিলা জামাতসহ ১০টি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়) । বর্ষাকালে ঈদগাহে যাওয়া বেশ ঝামেলাপূর্ণ ছিল। মুন্সীবাড়ির নিকটে একটি আর ঈদগাহের সামনে একটি বাঁশের সাকো ছিল। এ সাকোগুলোতে সাধারণত একটি বাঁশ ধরার জন্য আরেকটি পাটাতন হিসাবে ব্যবহৃত হতো। আমরা অনেক সময় খালের এপাড় থেকেই মুরুব্বীদের নামাজ পড়া দেখতাম। কারণ ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সাকো পাড় হয়ে ওপাড়ে যেতে পারতাম না। ঈদের নামায শেষে ধনী-গরীব, ছোট-বড় সকল পেশা ও বয়স এর লোক সবই সবার সাথে আন্তরিকভাবে কোলাকুলি করতেন। এ দৃশ্য যেন এখনও আমার চোখে পানি আসে। তারপর বাঁশের সাকো পাড় হয়ে আব্বা এসে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আমাদের পরিবারে পায়ে ধরে সেলাম করার রীতি প্রচলিত ছিল না। তারপরও নামাজ শেষে কে কোন ক্লাশে পড়ি সে অনুযায়ী বড় ভাই ( লেয়াকত আলী, সহকারী শিক্ষক, এলাহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়) সেলামী দেয়া শুরু করতেন । সেলামী পেতাম ১, ৫, কিংবা ১০ টাকা। ( সেসময় ১ মার্কিন ডলারের দাম ছিল বাংলাদেশী টাকায় ১০ টাকা)। ঈদের সময় কোন কোন বছর বিশেষ করে ঈদুল আজহাতে বর্তমান “মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে” ন্যাপের বিশাল কর্মী সমাবেশ হতো। সেখানে অংশ গ্রহন করতেন মতিয়া চৌধুরীসহ আরো অনেক খ্যতিমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কবি জসিম উদ্দিনও একবার এসছিলেন বলে জানা যায়। তবে ঈদুল ফিতরে এলাহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় ( অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের বাবা কেয়াম উদ্দিন মাস্টার কর্তৃক ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) মাঠে বিরাট ফুটবল প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। এখনও এলাহাবাদ মহাবিদ্যালয় ও এলাহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে প্রীতি ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সেসময় শুধু ফুটবল প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হত। খেলা উপলক্ষে ভ্রাম্যমান দোকান বসত স্কুলের পাশের গাবতলীতে। সেখান থেকে সেলামী থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে হাতে বানানো বহু ধরণের তেল মশলা দিয়ে তৈরি করা বিশেষ ধরণের চানাচুর খেতাম। চকলেট খেলে চকলেটের প্যাকেটের ভেতরে থাকা বিশিষ্ট খেলোয়ার সালাহ ঊদ্দিনের ছবি সংবলিত স্টিকার সংগ্রহ করতাম। খেলায় আমার প্রিয় দল জিতলে মিছিল করতে করতে বাড়ি ফিরতাম। রাতে কোন পড়া ছিল না। তবে আগে থেকেই বাতির ব্যবস্থা করে রাখতাম। বাতি বলতে তখন কেরাসিনের “কুফি বাতিই” বা চেরাগ বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। তবে কোন কোন পরিবার রনার তেলও ( স্তানীয়ভাবে সংগৃহীত) ব্যবহার করত। এ তেল একটি বাটির মধ্যে রেখে একটি পাটের সলতে দিয়ে বাতি জ্বালানো হতো। যদি আকাশ ভালো থাকতো কোন কোন বাড়ির উঠানে নলপুকুরিয়ার আব্দুল হাকিম আসতেন গল্পের আসর জমানোর জন্য। গাজি- কালুর পুঁথি পাঠও তখন প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ কারবালার জারি গাইত। তবে বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব আমার দাদা আলী আক্কাস মুন্সী এ ধরণের গল্প-গুজবের কোন প্রোগ্রাম আমাদের বাড়িতে করতে দিতেন না। আমাদের গ্রামে একমাত্র টেলিভিশন ছিল সাত্তার ভূইয়ার বাড়িতে । অন্যান্য দিন অনুমতি না পেলেও দুই কিলোমিটার দূরে সে বাড়িতে ঈদের প্রোগ্রাম দেখার অনুমতি পেতাম। প্রথমবার যখন গেলাম সেখানে গিয়ে দেখি ঘরের বারান্দায় টিভি লাগানো। উঠানে প্রায় ২ শ লোক পাটি বিছিয়ে বসে বসে নাটক দেখছে। পরবর্তীতে ম্যরাডোনার বিশ্বকাপ মিশনও সে বাড়িতে গিয়ে দেখেছি। পরকর্তীতে প্রবাসী জুনাব আলী রঙিন টিভি আনার পর আর সেখানে টিভি দেখার জন্য যাইনি। সে বাড়িতে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই একজনের সাথে দেখা করার জন্য ডাক আসে। ( তখনই হঠাৎ মনে হলো এটিতো হেড স্যারের বাড়ি । যদিও হেডস্যার মরহুম আব্দুল মতিন কুমিল্লার বাসায় থাকতেন ) যা ভাবলাম তাই হলো। তবে ভয়ংকর কিছু ঘটেনি। কারণ আমাদের ফ্যামিলির প্রতি ওনার অন্তরে একটা সফ্ট কর্ণার ছিল, কারণ আমাদের পাঁচ ভাইয়ের সবাই এ বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সবাই পর্যায়ক্রমে ফার্স্টবয় ছিলাম। স্যার শুধু জিজ্ঞেস করলেন তোমার আব্বার কাছে বলে আসছনি ? টাক মাথাওয়ালা সে স্যারের কথা এবং এসিস্ট্যান্ট হেড স্যার জনাব চাঁন মিঞার কথা আজও মনে পড়ে। “ বিজ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছে বেগ , কেড়ে নিয়েছে আবেগ। ” তাই বর্তমানে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়া আমরা অনেকটাই ভুলেই গিয়েছি। তখন মোবাইল ছিলনা তবে জরুরী প্রয়োজনে কুমিল্লা গিয়ে টেলিগ্রাম করা যেত। যাক যে কথা বলছিলাম, রমজানের শেষের দিকে অপেক্ষায় থাকতাম কখন মামা ( মরহুম সামছুল হক, সহকারী শিক্ষক , তুলাগাও দাখিল মাদ্রাসা) আমাদেরকে ঈদের দাওয়াত দিতে আসবেন। ঈদের পরের দিন সকালে মামার বাড়িতে রওয়ানা হতাম। ৪/৫ কিলোমিটার দূরে তুলাগাও যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয় (আরো ছোট থাকতে অবশ্য নৌকাযোগে যেতাম)। কিছুক্ষণ হেঁটে বলতাম আম্মা আর কত দূর ? আম্মা বলতেন ।ওই যে তাল গাছওয়ালা বাড়িটা দেখা যায় সেটা পাড় হলেই তোদের মামার বাড়ি দেখা যাবে। তাল গাছওয়ালা, তুলাগাছওয়ালা কত বাড়িই পাড় হয়ে যাই কিন্তু পথ আর শেষ হয় না, মোটামুটি বড় হয়ে যাওয়ায় কোলে উঠার কথাও বলতে পারিনা। তাই মেঠো পথের ধারে বটগাছ পেলে সেখান কিছুটা ঝিরিয়ে নিতাম। শেষ পর্যন্ত একসময় পৌঁছে যেতাম তুলাগাও নোয়াপাড়ার সালাম মৌলবীর ( দেওবন্দ থেকে পাশ করা ) বাড়িতে। মনোয়ারা খালা দূর থেকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে কোলে নিয়ে বাঁশের সাকো পাড় করে নিয়ে যেতেন। তখন আমি লজ্জায় মুখ লুকালেও খালার ভালবাসা ও আন্তরিকতার কারণে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতামনা। ঈদ সবসময়ই আনন্দের। এ যেন না পাবার মাঝেও অনেক কিছু পাওয়া। তাই ঈদ প্রতিটি মানুষের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, হাসি, এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যপ্তি লাভ করুক এটাই ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। সকলের জন্য রইল ঈদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন।

লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক , কলাম লেখক ও ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা।