সাহিত্য চর্চার আড়ালে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফিতে টিপু কিবরিয়া
আসল নাম টি আই এম ফখরুজ্জামান হলেও পরিচিত টিপু কিবরিয়া নামে। একসময় তিনি সেবা প্রকাশনী পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিশুসাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবে কামিয়েছেন নাম-যশ। বেশ কয়েকটি ছড়ার বই ছাড়াও ‘হরর ক্লাব’ নামে শিশুদের জন্য রয়েছে সিরিজ বই।
আদতে তার পরিচয় সুনামের মনে হলেও আড়ালে তিনি ভয়ঙ্কর ও বিকৃত মানসিকতার। টিপু কিবরিয়া বাংলাদেশে বসে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িত থাকার কারণে অনেক দেশে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচার অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০১৪ সালের জুনে প্রথম গ্রেফতার করেছিল টিপু কিবরিয়াকে। তখন ওই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়। দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে থাকার পর তিনি ২০২১ সালে হন কারামুক্ত। এরপরও স্বভাব বদলায়নি টিপু কিবরিয়ার।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে কিশোর কবিতা, গল্প ও ছড়া ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে তিনি ‘হরর ক্লাব’ নামে কিশোরদের জন্য সিরিজ গল্প লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেবা প্রকাশনী থেকে তার এসব লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। এক সময়ের খুবই জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য লেখার সুবাদে মিশেছেন অনেক শিশুর সঙ্গে। ২০০৫ সালের দিকে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নজরদারিতে থাকা টিপু কিবরিয়াকে আবার গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে কামরুল ইসলাম নামক সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের একটি টিম।
সিটিটিসি বলছে, টিপু কিবরিয়া আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের বাংলাদেশি মূলহোতা। তার বাসা থেকে ক্যামেরা, পিসি, ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা ছবি ও এক হাজারের মতো ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া গেছে। শিশু পর্নোগ্রাফির ভুক্তভোগী শিশুরা সবাই ছিন্নমূল পথ ছেলে শিশু।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরের গুলিস্তান, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ শহরের বিভিন্ন স্থানের ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ছিন্নমূল পথশিশুদের পর্নোগ্রাফির কাজে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যুক্ত করা হয়। সামান্য অর্থের প্রলোভনে বাসায় নিয়ে গিয়ে অশ্লীল ও গোপনাঙ্গের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক যে ক্লায়েন্ট আছে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। শুধু তার বাসায় নয় বিদেশি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মাফিক বন-জঙ্গলে ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে গিয়ে পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও করেন। তার বাসায় পর্নোগ্রাফির ভিডিও এডিটিং প্যানেল আছে। সেখানে তিনি এডিটিং করে মেইলে পাঠাতেন। যা পরে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হতো।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আগে তিনি ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠাতেন। পরবর্তীতে মেগা ও টোটেনা নামক দুটি এনক্রিপটেট অ্যাপসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে পর্নোগ্রাফির কনটেন্টগুলো পাঠাতে শুরু করেন। কিবরিয়ার কাছ থেকে যে ডিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ আরও অনেক দেশের গ্রাহকদের তালিকা পাওয়া গেছে। যাদের কাছে তিনি বিকৃত, অশ্লীল পর্নোগ্রাফির ভিডিও ও ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন।
তার কাছ থেকে উদ্ধার সব ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে ফরেনসিক করে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার অশ্লীল ছবি ও এক হাজার ভিডিও পাওয়া গেছে। ফরেনসিক বা ফিল্টারিংয়ের কাজ শেষ হলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, মাত্র ৫০০ থেকে হাজার টাকার প্রলোভনে টিপু কিবরিয়া ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে আসতেন। তার চক্রে কামরুল ছাড়াও আরও অনেক সহযোগীর নাম পাওয়া গেছে। দুজনকে গ্রেফতারের সময় এক ভুক্তভোগী শিশুকে উদ্ধারের পর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
টিপু কিবরিয়া কত টাকা পেতেন, কীভাবে পেতেন- জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, অর্থের লেনদেন হতো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও কিছু মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে। ৩/৪টি ছোট ছোট ভিডিও পাঠালেই তিনি পেতেন হাজার ডলার। সর্বশেষ এক বিদেশি গ্রাহককে তিনি তিনটি পর্নোগ্রাফিরি ভিডিও পাঠিয়ে এক হাজার ডলার পেয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার এজেন্ট। এরকম বেশ কজন এজেন্টকে শনাক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ২৫/৩০ জনের মতো ভুক্তভোগী শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা সব ছেলে, সংখ্যা অনেক।
এর আগে ২০১৪ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, টিপু টাকার বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অন্তত আট আন্তর্জাতিক পর্নোপ্রাফি চক্রের কাছে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও ও স্থিরচিত্র পাচার করে আসছিলেন।
ওই সময় ইন্টারপোলের বরাত দিয়ে সিআইডি জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্নো ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত টিপু কিবরিয়া। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশু পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচার হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগের বিষয়ে নজরদারি করে টিপুর চেহারা শনাক্ত করে ইন্টারপোল। ওই সময় টিপুর বাসায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক পর্নো সিডি, লুব্রিকেটিং জেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন