‘একাকী মৃত্যু’র মিছিল : কেউ জানে না, তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে?

অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলতেই পচা-বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। ধীরে ধীরে ঢুকলেন আগন্তুক। ভেতরে পড়ে রয়েছে একটা মৃতদেহ। মেঝেতে বিছানো ‘ফুটন (শোবার জন্যে মেঝেতে পাতা ম্যাট্রেস)’। চাদরটা ময়লায় কালচে হয়ে গেছে। এখানে সেখানে পড়ে থাকা পোশাক, পাশের টেবিলে রাখা সংবাদপত্র আর ঘোড়দৌড় দেখার টিকিটগুলো পোকায় খেয়ে ফেলেছে। উড়ছে মাছি। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার পর শীত আসতে হয়ত দেরি করেনি। যদি তিনি গ্রীষ্মে মারা যেতেন আর কয়েক মাস এভাবেই গরমে পড়ে থাকতেন, তবে অবস্থা আরো খারাপ হতে পারতো।

‘একাকী মৃত্যু’র চিত্র এটি। যা কিনা জাপানের অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। সেখানে নাকি প্রতি ১০টি মৃত্যুর একটি ঘটে এভাবে। একাকী মানুষগুলো সবার চোখের আড়ালে মরে পড়ে থাকেন। মৃতদেহগুলো খুঁজে পাওয়ার বহু আগেই তাদের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়।

অনেক দেশেই অনেক মানুষ আছেন যারা শেষ জীবনটা একাকী কাটাচ্ছেন। হয়তো আত্মীয়-স্বজনের অজ্ঞাতেই মারা যাচ্ছেন তারা। কিন্তু জাপানের মতো এত বেশি ঘটনা আর কোথাও ঘটে না। এমনিতেই এখানকার মানুষ সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচেন। তাদের বয়োবৃদ্ধদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যার সিকিভাগেরই বেশি ৬৫ পেরিয়েছেন। এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ জাপানের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হবেন।

একাকী মৃত্যুর স্বচ্ছ পরিসংখ্যান করা খুব কঠিন বিষয়। কেন্দ্রিয় সরকার এসব তথ্য সংগ্রহ করে না। তবে স্থানীয় সরকারি অফিসের হিসাবে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে টকিও থিঙ্ক ট্যাংক এনএলআই রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক হিসেবে জানিয়েছে, প্রতিবছর ৩০ হাজার মানুষের এমন মর্মস্পর্শী মৃত্যু ঘটে। কেউ জানতে পারে না, তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে? অনেক দিন পয় হয়তো খবর মেলে।

একাকী মৃত্যু যেহেতু বাড়ছে, কাজেই এদের সৎকারের জন্যে গড়ে উঠেছে ‘লোনলি-ডেথ-ক্লিনআপ’ ইন্ডাস্ট্রি। বেশ কিছু ফার্ম এসব মৃতদেহ উদ্ধার এবং পরিষ্কারের কাজ করছে। ইন্স্যুরেন্স কম্পানিগুলো বাড়ির মালিকদের নিরাপত্তায় বিভিন্ন পলিসি গ্রহণ করছে। কারণ, তাদের বাড়িতে সবার অগোচরে মরে পচতে থাকে ভাড়াটে। উদ্ধার হওয়ার পর ঘরগুলো আবার নতুন করে সাজাতে হয়। নয়তো নতুন ভাড়াটে উঠতে চায় না। অনেকে প্রার্থনার মাধ্যমে পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

তেমনিভাবে মৃত্যুবরণ করলেন ৫৪ বছর বয়সী হিরোয়াকি। তার কয়েক মাসের ভাড়া বাকি ছিল। ওই বাড়ি যে রিয়েল এস্টেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানির অধীনে ছিল তার এক রিপ্রেজেন্টিটিভ খোঁজ নিতে এলেন। দরজা খোলাই ছিল। খুলতেই বাজে গন্ধে ভেতরটা মোচড় দিল। ফুটনে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই মারা গেছেন হিরোয়াকি। চারদিকটা কেমন যেন শুকনো। শীত ছিল দেখে বাজে গন্ধ চারদিকে খুব বেশি ছড়ায়নি। একেবারে পচে-গলেও যায়নি দেহটি।

খবর পেয়ে আসলো একাকী মৃতদের উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান। সবকিছু তোলা হলো প্লাস্টিক ব্যাগে। এই ব্যাগগুলো রাখা হলো বায়ুশূন্য পাত্রে।

ওই দুশো বর্গফুট অ্যাপার্টমেন্টের পুরোটা জুড়ে কেবল একাকীত্বের চিহ্ন। ইনস্ট্যান্ট নুডলসের বাটি, সফট ড্রিঙ্কসের খালি বোতল, কফির ক্যান, আধখাওয়া সিগারেট, ডজন ডজন লাইটার, কয়েক মাসের পুরনো সংবাদপত্র, কাপড়- সবই পড়ে রয়েছে একাকী মৃতদেহের সঙ্গী হয়ে। তার মেঝেতে ছড়িয়ে ইউটিলিটি বিলের কপি। এখানে সেখানে ময়লার পলিথিন। সবই কয়েক মাসের পুরনো। মালিকের দেহের সব তরল ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হিরোয়াকির বয়স ৫৪। বিবাহ বিচ্ছেদের পর একাকী থাকতেন তিনি। গত ২০ বছর ধরে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেছেন। নিশান বা ফুজিৎসুর মতো বড় কম্পানিতে ছিলেন ভদ্রলোক।

এমন হাজারো মানুষ বৃদ্ধ হচ্ছেন আর একা হয়ে পড়ছেন। শেষ বয়সেও তাদের আশপাশে কাউকে দেখা যায় না। স্বজনরা কে কোথায় আছেন তার কোনো খবরও থাকে না। কেবল স্থানীয় পত্রিকাগুলো ভরে ওঠে একাকী মৃত্যুর খবরে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কর্মীরা এসে সব ধুয়ে মুছে দিয়েছেন। নতুন করে ওয়ালপেপার লাগানো হয়েছে। আসবাব বদলেছে। ঘরের পুরো চেহারাই বদলে গেছে, যেন এখানে হিরোয়াকি নামের কেউ কোনদিনও ছিলেন না!

সূত্র : এনডিটিভি