পাঁচ বছরের চুক্তিতে ১৪ বছর পার, ভাঙা ক্রেনেই চলছে বেনাপোল

দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরের অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট অকেজো হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দরের মালামাল খালাস প্রক্রিয়া। আমদানিকারকরা বন্দর থেকে সময়মতো তাদের পণ্য খালাস করতে না পারায় বন্দরে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ পণ্যজট। বন্দরের গুদাম থেকে পণ্য বের করার পর নতুন পণ্য ঢোকাতে হচ্ছে। জায়গার এ সংকটের কারণে পণ্যবোঝাই ভারতীয় ট্রাক বন্দরের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে থাকছে দিনের পর দিন। ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর অনুমতি মিললেও ক্রেন ও ফর্কলিফট বিকল থাকায় বিপাকে পড়ছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

তবে বেনাপোল স্থলবন্দরে ফর্কলিফট ও ক্রেন সরবারহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সীস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম লিমিটেড বলছে ভিন্ন কথা। বন্দরে ৫ বছরের চুক্তিতে ১৪ বছর ধরে কাজ করলেও তারা বলছে অনেকটা বাধ্য হয়ে বন্দরের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। দেনা পাওনা পরিশোধ করা হলে আমরা বন্দরের কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালে বেনাপোল বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ওয়্যারহাউজিং কর্পোরেশনের মাধ্যমে বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে মোংলা বন্দরের অধীনে এর কার্যক্রম চলত। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এটি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনেই পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশের সিংহভাগ শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ও বিভিন্ন প্রকল্পের বেশির ভাগ মেশিনারিজ আমদানি করা হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। ক্রেন ও ফর্কলিফট ছাড়া এ জাতীয় পণ্য বন্দরে আনলোড ও বন্দর থেকে খালাস নেওয়া সম্ভব নয়।

মোংলা বন্দর থেকে ২০০২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পর অতি পুরাতন ক্রেন ও ফর্কলিফট মোংলা বন্দর থেকে ভাড়া করে এনে এখানে কাজ চালায় বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০০৬ সালের ২১ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঢাকার মহাখালীর মেসার্স সীস লজিস্টিক্যাল সিস্টেমের পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট থেকে তারা বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পায়। তারা বন্দরে ৬টি ফর্কলিফট ও ৫টি ক্রেন দিয়ে মালামাল পরিবহনের কাজ করার পর ওই বছরের ১০ নভেম্বর আরো ৬টি নতুন ফর্কলিফট নিয়ে আসে।

কয়েকদিন কাজ করার পর এসব ফর্কলিফট ও ক্রেণ অকেজো হওয়া শুরু করে। কিন্তু মেরামতের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। চুক্তি অনুযায়ী ৫টি বিভিন্ন ধারণক্ষমতার ক্রেন ও ১১টি ফর্কলিফট দিয়ে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ৬টি ক্রেন ও ৯টি ফর্কলিফট অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

বর্তমানে বেনাপোল বন্দরে ২৫ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ফর্কলিফট রয়েছে একটি ও পাঁচ টনের ফর্কলিফট রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে ৪টি দীর্ঘদিন ধরে অচল। ৪০ টন, ৩৫ টন ও ১৯ টনের ক্রেন আছে একটি করে, আর ১০ টনের ক্রেন আছে দুইটি। এসব ক্রেনের মধ্যে ৫টি থাকে অধিকাংশ সময় অকেজো। বর্তমানে সবচেয়ে বড় ২৫ টনের ফর্কলিফটি অকেজো থাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটছে মালামাল লোড-আনলোডে।

২০১৬ সালে বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে আগের হ্যান্ডলিং ঠিকাদার মেসার্স সীস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম উচ্চ আদালতে রিট করে। এর ফলে বন্ধ হয়ে যায় দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া। ফলে এই কোম্পানি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর এ কারণে এ পথে আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে দু’দেশের বন্দর ব্যবহারকারীসহ ব্যবসায়ীরা।

বন্দর ব্যবহারকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চুক্তি অনুযায়ী ইকুইপমেন্ট হ্যান্ডলিং কোম্পানি নতুন কোনো ইকুইপমেন্ট এখানে দেননি। সবই পুরাতন। মাঝেমধ্যে মেরামতের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই পুরনো। ফলে মাস না ঘুরতেই ফের তা অচল হয়ে পড়ে। বন্দরে যেসব ক্রেন ও ফর্কলিফট ব্যবহার করা হচ্ছে তার অধিকাংশই ভাড়া করা ও পুরাতন। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো রকম দায়সারা গোছের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

ফর্কলিফট ও ক্রেন সরবারহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম লিমিটেডের বেনাপোলের ম্যানেজার ফখরুল ইসলাম জানান, ২০০৬ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্দরের পণ্য ওঠানো ও নামানোর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ৫ বছরের চুক্তি করে। পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ আর চুক্তি নবায়ন করেনি। আমাদের কোম্পানির দেনা পাওনাও পরিশোধ করেনি। আমরা অনেকটা বাধ্য হয়ে গত ১৫ বছর ধরে পুরাতন চুক্তিতে বন্দরের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ১৫ বছর আগের চুক্তিতে বর্তমানে বন্দরের কার্যক্রম চালানো সম্ভব না। আমাদের দেনা পাওনা পরিশোধ করা হলে আমরা বন্দরের কার্যক্রম গুটিয়ে নেব।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, ৫১ হাজার টন ধারণক্ষমতার বন্দরে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টন পণ্য ওঠানো-নামানো হয়। এসব পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য ন্যূনতম সাতটি ক্রেন ও ৩০টি ফর্কলিফট প্রয়োজন। সেখানে একটি ক্রেন ও ২টি ফর্কলিফট দিয়ে কাজ করানোর ফলে সেগুলো প্রায় সময় বিকল হয়ে পড়ে থাকছে।

ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করে বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার জানান, বর্তমানে স্থলপথের পাশাপাশি রেলপথেও প্রচুর পরিমাণ মালামাল আসছে ভারত থেকে। সেজন্য জায়গার কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে বন্দরে ক্রেন ফর্কলিপট এর সমস্যা আছে। আইনি জটিলতার কারণে সমস্যাগুলো হচ্ছে, অচিরেই এসব সমস্যা সমাধান করা হবে।

এদিকে আগামী দু’মাসের মধ্যে বেনাপোল বন্দরে জরুরি ভিত্তিতে ক্রেন, ফর্কলিফট, নতুন ৫টি শেড নির্মাণ ও জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কে এম তারিকুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি বেনাপোল বন্দর অডিটরিয়ামে বন্দর, কাস্টমস, পুলিশ, আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।