সাতক্ষীরার কলারোয়ায়

পুকুরপাড়ে আশ্রয়ণের ঘর করলেন সাবেক ইউএনও, সরিয়ে নিলেন বর্তমান ইউএনও

সাতক্ষীরার কলারোয়ায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ৭টি ঘর রাতের আঁধারে স্কেভেটর দিয়ে ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

৭-৮ দিন আগে থেকে উপজেলার ৪নং লাঙ্গলঝাড়া ইউনিয়নের তৈলকুপি গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ঘরগুলো ভেঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তবে প্রকল্পে নির্মিত ১৩টি ঘরের মধ্যে বাকি ছয়টি ঘর নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই সাতটি ঘর ভেঙে সরানো হলো।

সদ্য বিদায়ী কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমি জেরিন কান্তার অনিয়ম- দুর্নীতি আড়াল করতেই এ ঘরগুলো ভাঙা হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকার অনেকেই।

লাঙ্গলঝাড়া ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘরগুলো সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত দরজা-জানালাগুলো অন্য একটি ঘরের মধ্যে রাখা হয়েছে। বর্তমান উপজেলা নিবার্হী অফিসার জুবায়ের হোসেন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার কি হচ্ছে? তখন তিনি জানালেন, এ সব ঘরে লোকজন তুলে দিলে প্রানহানির আশংকা রয়েছে। তাই ঘরগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’

স্থানীয় ৪নং লাঙ্গলঝাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বলেন, ‘মজিববর্ষ উপলক্ষে আমার ইউনিয়নে তৈলকুপি গ্রামের খাস জমিতে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য দুই সারিতে মোট ১৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এক পাশে সাতটি এবং অপর পাশে ৬টি। এর প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু পাশে পুকুর থেকে বালি তোলার কারণে সাতটি ঘর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে হতদরিদ্রদের জন্য এসব ঘর তৈরী করা হলেও তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই সেই ঘরগুলো ভেঙে অন্যত্র নেওয়া হয়েছে।’

ওই প্রকল্পে ডিজাইন বর্হিভূত জোড়াঘর নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে কলারোয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুলতানা জাহান বলেন, ‘তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী জেরীন কান্তার সময় উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ১২০টি ঘরের মধ্যে ডিজাইন অনুসরণ না করে ৪০টি জোড়াঘর নির্মাণ করা হয়। ঘরের কাজ শুরু করার আগেই আমাকে না জানিয়ে ঘর নির্মাণের জন্য রড, বালি, সিমেন্ট, ইট, কাঠ, ঢেউটিন ক্রয় করা হয়। আর এসব তিনি তার কার্যালয় থেকে মিস্ত্রী সুবাসের মাধ্যমে ঘর নির্মাণ স্থানসমূহে সরবরাহ করতেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘পরবর্তীতে আমি জানতে পেরে, ঐ প্রকল্পের সদস্য-সচিব হিসেবে বাধা প্রদান করি তখন সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, উপকারভোগী নির্বাচন, স্থান নির্বাচন, লে-আউট প্রদান, মালামাল ক্রয়সহ আপনার কোনকিছু দেখার বা মন্তব্য করার দরকার নেই। তারপরও আমি উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয় ও মিস্ত্রী সুবাসের উপস্থিতিতে ডিজাইন অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে ঘর নির্মাণ করতে হবে বলা মাত্রই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় স্পষ্ট করে বলে দেন, আপনার কাজ কেবলমাত্র মিস্ত্রী সুবাসের নিকট থেকে কয়টি ঘর নির্মাণ হলো এটা বুঝে নেয়া এবং বিলে স্বাক্ষর করা। এরপর বিষয়টি আমি তাৎক্ষণিকভাবে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মহোদয়কে মৌখিকভাবে কয়েকবার অবহিত করি। এমনকি লিখিতভাবেও জানায়। এর ফলে আমাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় ঘর তদারকি করে প্রতিবেদন জমা দেয়া নিয়ে কারণে অকারণে হয়রানিমূলক শোকজও করেন।’

বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ঘরগুলো তার আগের ইউএনও নির্মাণ করেছিলেন। কোন দুর্নীতি ঢাকতে নয়, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নির্মাণের কারণে ঘরগুলো সরানো হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ঘরগুলো পুকুরের পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে পুকুরে প্যানাসাইডিং দিয়ে ঘরগুলো বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাতেও তেমন কোনো ফল না পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিষদের সবার সাথে আলোচনা করে ঘরগুলো ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে ঘরগুলো ভেঙ্গে পার্শ্ববর্তী ৬নং সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাদিয়ালী গ্রামে ৪২ শতক খাস জমি পাওয়ায় সেখানে ঘরগুলো নির্মাণের জন্য নেওয়া হয়।’

আর্থিক অপচয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বসবাসকারীদের জীবনের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে ঘরগুলো সরানো হয়েছে। এখানে টাকার চেয়ে জীবনের কথা বেশি বিবেচনা করা হয়েছে। এমনকি ঘর ভেঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি ভূমিহীনরাও সম্মতি দিয়েছেন।’

সাবেক উপজেলা নিবার্হী অফিসার মৌসুমী জেরিন কান্তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আমরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ যখন ওই স্থানটি নিবার্চন করেছিলাম তখন ওখানে এটেল মাটিসহ ভালই মনে করেছিলাম। পরবর্তীতে দেখা যায় পাশের পুকুর থেকে বালি উত্তোলন করায় ঘরের পাশের মাটি ধসে পড়ছে। তাই বর্তমান উপজেলা নিবার্হী অফিসার ওই ঘরগুলো ঝুঁকি মনে করে ঘরগুলো ভেঙ্গে সরিয়ে ফেলেছেন বলে জেনেছি। তাছাড়া এ প্রকল্পে আমাদের মাটি পরীক্ষা করার মতো দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন না। কেবল মাত্র উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাটি পরীক্ষার জন্য দায়িত্বে ছিলেন। এ কারণে আমরা বুঝতে পারি নাই যে ওই মাটি ধসে পড়বে।’

কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু জানান, ‘তৈলকুপি গ্রামে ঘর নির্মাণ করা হয় পুকুরের পাড়ে। সদ্য বদলি হওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমি জেরিন কান্তা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ঘরগুলো নির্মাণ করেন। ফলে অল্প দিনেই ঘরগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ওই স্থানে ঘর নিমার্নের জন্য আমি ও উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাঁধা দিয়ে ছিলাম। তারপরেও তিনি ওই স্থানে ঘর নির্মাণ করেছেন। তাছাড়া ইতোমধ্যে ঘরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য পুকুর ভরাটের জন্য আরো ছয় লাখ টাকা খরচ করা হয় উপজেলা অফিস থেকে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।’

সম্প্রতি কয়েকদিন ধরে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো ভেঙে রাতারাতিই ইটসহ বিভিন্ন মালামাল সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে তিনি জানান।

উপজেলা চেয়ারম্যান আরো বলেন, এভাবেই সাবেক ইউএনও উক্ত প্রকল্পের ১২০টি ঘরই নিজের ইচ্ছামত নিমার্ন করেছেন। কোন ঘরেই তিনি সঠিকভাবে মালামাল দেননি।’

এই প্রকল্পে নির্মিত ঘরগুলো সম্পর্কে সঠিক তদন্ত করে প্রধানমন্ত্রীর নিকট সাবেক ইউএনও মৌসুমী জেরিন কান্তার দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তির আহবানও জানান তিনি।

ছবিতে..