বিনা টাকায় ঢাকা শহরে দুপুরের খাবার!

পৃথিবীতে গরীবের কেউ নেই- কথাটিকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা থেকেই দুই বছর আগে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এম এনামুল শুরু করেছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা। দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন আয়ের মানুষদের এক বেলা খাবারের জোগান দিচ্ছে আমিন মোহাম্মদ মেহমানখানা। এটি আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এটি।

হাল আমলে বাঙালি তার অনেক স্বকীয়তাই ভুলতে বসলেও কিছু মানুষের এখনো ভালো লাগে মেহমানদারি করতে। এখনো বাঙালির আন্তরিকতা ও মানবিকতার প্রমাণ মেলে। আগের যুগে মানবসেবার নিদর্শন হিসেবে মুসাফিরখানা চালু করতেন ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। বাংলাদেশী ভূমিতেও অনেক মুসাফিরখানা চালু ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের মেহমানদারি হতো সেখানে। হাল আমলে তা আর দেখা যায় না। তবে কিছু মানুষ এখনো ব্যতিক্রম- যারা মানুষ নিয়ে ভাবেন, সমাজ নিয়ে ভাবেন।

সে রকম ভাবনা থেকেই পথচলা শুরু হয়েছে ঢাকাই মেহমানখানার। এ মেহমানখানার মেহমান হতে কোনো বাধা নেই। কোনো নিয়ম নেই। যে-কেউ চাইলেই মেহমান হতে পারেন। ঢাকার বাসিন্দা হলেও ঢাকাতেই হবে আয়েশি পেটপুজো। এ জন্য যেতে হবে আপনাকে বাড়ির পাশে ধানমন্ডিতে। আমিন মোহাম্মদ মেহমানখানায়। সমাজসেবা ও মানবসেবার উদাহরণ বহু দেখা যায়। তবে অতিথিপরায়ণ বাঙালি ঐতিহ্যের নতুন সংযোজন এই ব্যতিক্রমী মেহমানখানা। এতে নেই কোনো বিনিময় আদান-প্রদান, নেই মেহমানের শ্রেণিবিন্যাস। সব শ্রেণিপেশার মানুষই এখানে সমান মর্যাদার অতিথি।

ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত এই মেহমানখানা প্রতিদিন ২২০০-২৫০০ জন মানুষের দুপুরের খাবার পরিবেশন

করে থাকে। তাই প্রতিদিন এখানে একবেলা খাবারের জন্য ভিড় করেন হাজার হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ। রিকশাচালক, দিনমজুর, পথশিশু এমনকি অল্প আয়ের কর্মচারীও আসেন একবেলা খাবারের জন্য।

১৬ টি বিশাল সাইজের পাতিলে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করা হয় এসব খাবার। প্রতিদিন দুপুরে সাড়ে ১২টা থেকে সিরিয়াল শুরু হয় এখানে। দূর থেকেই দেখা যায় কয়েকশ’ রিকশা মেহমানখানার সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো। খাবারের হাড়ি নিয়ে বসে থাকেন মেহমানখানার কর্মচারী। একে একে প্লেটে করে দেন খাবার। মেহমানখানায় আসা মানুষ ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও এ খাবার খান।

নারীর সংখ্যাও কম নয়। বাচ্চাকাচ্চা নিয়েও কয়েকজন এসেছে। ভরপেট আয়োজন। কোনো কমতি নেই। যত খুশি ততবার নেয়া যায় খিচুরি। মেহমানখানায় কোনো মেহমানকেই আধপেটা থাকতে হবে না। আগেই শুনেছিলাম তবু খেয়াল করে দেখা গেল অনেকেই টিফিন বক্স, হাঁড়ি, বাটি, ছোট বালতি নিয়ে এসেছেন। কারণ তারা খেয়ে নিয়ে যাবেন পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য। কতটা পরিমাণ পার্সেল দেয়া হয় জানতে চাইলে বিতরণকারীরা বললেন- যার পাত্রে যতটা ধরে!

এখানে প্রতিদিন মূলত পাতলা খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। খিচুড়ির মধ্যে মুরগি এবং সবজিও থাকে। মেহমানখানায় গেলে দেখা যায় দুপুরে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন সবাই। স্বাদ এবং মানের কথা বেশ ভালো বলে জানান অতিথিরা। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় কঠোর তদারকিতে বাজার থেকে শুরু করে রান্না এবং খাবার বিতরণ সবই সম্পন্ন করা হয়। প্রচারণা নয়, বরং একবেলা মানুষকে তৃপ্তি করে খাওয়ানোই মেহমানখানার মূল লক্ষ্য।

চার পাশ খিচুরির সুগন্ধে ম ম করছিল। বোঝাই যাচ্ছিল যথেষ্ট যত্ন নিয়ে রান্না করা হয়। তবুও কথা হলো কয়েকজন মেহমানের সাথে। খাওয়া শেষে রিকশায় বসেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মনির। বললেন, তিনি হঠাৎই জানতে পারেন এই আয়োজনের কথা। এখন দুপুর হলেই এখানে চলে আসেন। এতে খাবার খরচটা বেঁচে যায়। আর খুবই স্বাদের খিচুড়ি। তার মতো অনেকেই এখন অন্য কোথাও আর খান না এবং তাদের মতো আরো যারা আছেন তাদের মধ্যে যারা জানেন না তাদেরও জানান। এভাবেই কোনো প্রচারণা ছাড়াই শুধু লোকমুখেই দিন দিন বাড়ছে মেহমানখানার প্রসার।

কথা বলেছিলাম এ মেহমানদারি আয়োজনের প্রধান তদারককারী গাজী আহমাদ উল্লাহর সাথে। হেড অব মিডিয়া, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। কেন এই আয়োজন? তিনি জানালেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে মানবতার সেবার লক্ষ্যেই এই আয়োজন। মানবসেবার মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ বাড়ে। সে চিন্তা থেকেই এ আয়োজন। মানুষকে পেট পুরে খাওয়ানোর মাধ্যমেই তাদের তৃপ্তি।

ভাবনাটা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের হলেও এ কাজে সংশ্লিষ্ট সবাই এখন কাজটাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। নিজ তাগিদেই তারা সুচারুভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেন মেহমানদারি। এ বছর মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছে মেহমানদারি। এখনো শুধু লোকমুখেই প্রচার হচ্ছে। কারণটা কী? জানালেন, কর্তৃপক্ষ কোনো রকম প্রচারণা চান না। নেক নিয়তে প্রচারণা ছাড়াই কাজ করতে চান।

কত দিন চলবে এ আয়োজন? সাথে সাথেই উত্তর দিলেন আল্লাহ যত দিন সামর্থ্য দেবেন। প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মেহমান খাচ্ছেন। চাইলে আপনিও যে কোনো দিন হতে পারেন মেহমান। আপনাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে ভুলবে না মেহমানখানার লোকেরা।