রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা থেকেই গেল!

সংলাপে রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা থেকেই গেল। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে এই আশ্বাসের বাইরে সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত আর কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যদি নতুন কোনো ঘোষণা না দেন, তাহলে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা শিগগির দূর হবে এমনটি আশা করা যায় না।

আপাতদৃশ্যে মনে হচ্ছে গ্রহণযোগ্য সমাধানের প্রস্তাবগুলো সংবিধানসম্মত কি না, তা নিয়েই উভয় পক্ষের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দ্বিতীয় দফা আলোচনায় যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তা সংবিধানের মধ্যেই সম্ভব বলে তাঁদের দাবি। তাঁদের প্রস্তাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে একজন

উপদেষ্টা ও ১০ সদস্যের উপদেষ্টাবিশিষ্ট নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা ও ১০ জন উপদেষ্টার বিষয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে এটা সংবিধানসম্মত নয়। এই দাবি মেনে নিলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়েও বলা হয়েছে, এটা হলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। এই বক্তব্যে স্পষ্টতই ধারণা মেলে যে সরকারের মধ্যে একধরনের শঙ্কা কাজ করছে। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার পথে একটি যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছানোর পথে প্রধান বাধাই যদি হয় শঙ্কা, তাহলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের অজ্ঞাত শঙ্কার কারণে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উপাদান নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, সেটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।

ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবগুলো নতুন কিছু নয় এবং এগুলো অনেক দিন ধরেই আলোচনায় আছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুটো নির্বাচনের সুযোগ রাখায় নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে একটি অরাজনৈতিক সরকার গঠন যে অসম্ভব নয় এই যুক্তি পুরোনো। সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টিতেও সংবিধানের ব্যাখ্যার প্রশ্ন জড়িত। আমরা জানি সংবিধানের ব্যাখ্যা দেওয়ার চূড়ান্ত ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের। যেহেতু সংবিধানের ব্যাখ্যা নিয়েই বিরোধ, সেহেতু বিরোধটি নিষ্পত্তির জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথাও তো বিবেচনা করা যায়।

প্রশ্ন উঠতে পারে সরকার কোনো ছাড় না দিলে রাজনীতিতে তার প্রধান প্রতিপক্ষ যে জোট সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আলোচনার প্রস্তাবে সম্মত হলো কেন? এর সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে প্রথমত, সরকার যে একগুঁয়েমি করছে না এমন একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা; দ্বিতীয়ত, সংলাপের পরিধি বিস্তৃত করে একে একটি অংশগ্রহণমূলক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে তুলে ধরা এবং তৃতীয়ত, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিপরীতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে উৎসাহিত করা, যাতে তাদের অংশগ্রহণকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে দাবি করা যায়।

আপাতদৃশ্যে, সরকার এটুকু সাফল্য অর্জন করেছে বলে মনে হলেও রাজনীতিতে বিএনপি এবং তার জোটই যে সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এই ধারণা দেশে-বিদেশে এত সহজে হারিয়ে যাবে না। ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বা হচ্ছে এমন দাবি খুব একটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।

বিপরীতে এই সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যে কোনো প্রাপ্তি নেই, তা নয়। ২০১৩ সালে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনে সাড়া না দেওয়ায় যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, এবার ফ্রন্ট আলোচনার প্রস্তাব দেওয়ায় তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে না। বরং জোটটি নির্বাচনে যেতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী, তার একটা প্রতিফলন এতে ঘটেছে। তাদের দাবিগুলোর সঙ্গে বাম জোটের দাবিগুলোরও অনেক মিল রয়েছে। ফলে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে সরকারের পক্ষের সুপরিচিত দলগুলোর বাইরে কয়েকটি ইসলামপন্থী দল এবং বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করা একটি গোষ্ঠী ছাড়া আর কেউই সরকারের আশ্বাস এবং বিদ্যমান ব্যবস্থায় অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করে না।

সংলাপ শুরুর পর স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হচ্ছিল যে রাজনৈতিক আচার-আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বিরোধী নেতা-কর্মীদের নানা অজুহাতে গ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ অনুষ্ঠানের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা প্রদানে তার উল্টো চিত্রই দেখা গেছে। সংলাপের প্রথম দিনে বিনা বাধায় সভা-সমাবেশ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পর ৬ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের দিনে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া, বিভিন্ন জায়গায় সরকার সমর্থকদের বাধা দেওয়ার ঘটনাগুলো সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গতকালের সংলাপে আবারও সভা–সমাবেশ করা এবং নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তার না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় সরকার প্রতিশ্রুতি পালন করবে।

সরকারের তরফে এর আগে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা ছোট আকারের হবে বলা হলেও এখন সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের পদত্যাগ করানো হলেও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা মন্ত্রীর মর্যাদায় বহাল আছেন। বলা হয়েছিল যে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনই প্রধান ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু বাস্তবে সব ধরনের বদলি-পদায়ন-পদোন্নতির মতো প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকার। এগুলোর কোনো কিছুই সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে না।

অতীতের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের হতাশাজনক ভূমিকার বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়। কমিশন পুনর্গঠনের দাবির বিষয়ে সরকারের নিস্পৃহতার পরও সরকারের আশ্বাসে তাদের বিরোধীরা আস্থা রাখবে এমন ভাবনা অযৌক্তিক।

সংকট সমাধানের বিষয়ে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই সংলাপের ইতি টানা সবার জন্যই হতাশাজনক। চাইলে পরে আরও আলোচনা হতে পারে সরকারের তরফে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, আমরা আশা করব সংলাপ নামে না হলেও সেই আলোচনা অব্যাহত থাকুক। তবে তা যেন সময়ক্ষেপণ অথবা শুধু প্রচার লাভের অনুশীলনে পরিণত না হয়।