কারবালার হৃদয়বিদারক ইতিহাস ইয়াযিদের মসনদ দখল

আমিরুল মু’মিনীন,খলিফাতুল মুসলিমীন,কাতীবে ওহী, হযরত মুআ’বিয়া রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু এর বিছাল শরীফের পর ইয়াযিদ মসনদে আরোহন করে এবং ক্ষমতারোহনের পর পরই সে আমূল পরিবর্তিত হয়।

যে সকল সদাচরণ ও সৎ গুনাবলির কারণে আমির হযরত মুআ’বিয়া রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু তার প্রতি আস্হা রেখেছিলেন, সর্বোপরি পুনঃবার উম্মাহকে ফিতনা ও বিভক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য তাকে যে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, ক্ষমতারোহনের পর পরই সে ঠিক তার বিপরীত রুপ প্রকাশ করে।

সে সেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং মহান দ্বীনী শরিয়তের খেলাফ কাজকর্ম শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে ও পদে যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের সরিয়ে ফাসিক-ফুজ্জার, অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেয়। মদ ও নারীর প্রতি যথেচ্ছ ব্যবহার প্রচলন করে। শরীয়তে যে সকল নারী বিয়ে করা অবৈধ, তেমন নারীদের বিয়ের জন্য সে প্রলুব্ধ হয়। জুয়ার প্রচলন করা হয়।

এক কথায় সে এমন সব কার্যকলাপ শুরু করলো যা একজন মুসলমান মাত্রই করতে পারেনা,খলিফা তো নয়ই। তার এসব ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপে ইসলামী শরীয়তের শাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।ইয়াযিদ ধৃষ্টতার চরম পর্যায়ে এসে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীদের কাছ থেকে বাইয়াত তলব করলো।

একেতো ইয়াযিদের অনৈসলামিক কার্যকলাপে তাঁরা অসন্তুষ্ট ছিলেন তারপর তার এমন বেয়াদবি মুলক আচরণ এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো।হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনারা মদীনা শরীফ ত্যাগ করে মক্কা শরীফ চলে গেলেন।মদীনা শরীফে ইয়াযিদ কর্তৃক নিয়োজিত গভর্নর বেয়াদব ওয়ালিদ, হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে বলেছিলো, ‘ইয়াযিদ আপনার বাইয়াত তলব করেছেন এবং এটি আপনার জন্য বাধ্যতামূলক।’জবাবে হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, ‘আমি এটা কী করে করতে পারি? তার মত অনুপযুক্ত লোকের হাতে আমি বাইয়াত করতে পারিনা। আমি কোন অবস্থায় এ ব্যাপারে রাজি নই।’ তিনি সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন এবং এটা তাঁর মর্যাদাগত সদাচরণই ছিল। সুবহানাল্লাহ!

মুলত তিনি যদি ইয়াযিদের প্রস্তাবে রাজী হতেন তবে অনেক কিছুই হতে পারতো। সর্বোপরি যা হতো তাহলো,পবিত্র দ্বীন ইসলামের আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য জায়িয বা বৈধ হয়ে যেতো।হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম প্রমাণ করে দিলেন যে, যত বড় বাঁধা বা হুমকি হোকনা কেন তিনি কখনোই আল্লাহ্ পাক প্রদত্ত ও তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত দ্বীন ইসলামের অবমাননা সহ্য করেননি।

ধর্মকে ধ্বংসের মুখে ছেড়ে দেননি এবং সত্য কখনোই মিথ্যার কাছে মাথা নত করেনা। করতে পারেনা।সাইয়্যিদুশ শুহাদা, সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ, রাইহানুর রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মওলা, আক্বা সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম নিজের আমল ও কর্মপন্থা দ্বারা তাঁর উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দিয়েছেন এবং জনগণের কাছে উনার শান -মান তুলে ধরেছেন।

হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম উনার মদীনা শরীফ ত্যাগ ও তার কারণঃ

হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম তাঁর পরিবারের সকলকে একত্রিত করে বলেন,’হে আমার প্রিয়জনেরা! ইয়াযিদ এমন প্রস্তাব করেছে যা আমি কখনোই গ্রহণ করবোনা। তারা আমাকে বাধ্য করলে নিশ্চয়ই যুদ্ধ হবে,ফাসাদ হবে। কিন্তু আমি চাইনা মদীনা শরীফে কোন লড়াই বা ফাসাদ হোক। এ অবস্থায় আমার মতে এটাই উত্তম,হিজরত করে মক্কা শরীফ চলে যাওয়া।’উনার আপন জনেরা বললেন,’আপনি আমাদের অভিভাবক, আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমরা তাই মেনে নিব।’

আহ্! পরিস্হিতি কতটা নাজুক হলে হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে মদীনাওয়ালা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি আগমন করবেন বলে হাজার বছর আগে থেকে সুসজ্জিত হয়েছে মদীনা মুনাওওয়ারা, যে মদীনা নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইশকে ছিলো মাতোয়ারা, যে মদীনার ওলীতে গলীতে হেসে খেলে বড় হয়েছেন আওলাদে রাসূলগণ, আজ সেই মদীনা সম্মানিত আওলাদগণকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে।হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পাক রওযা শরীফে উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করেন এবং অশ্রুসজল নয়নে হিজরতের অনুমতি নিলেন।

এরপর তিনি আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে হিজরী ৬০ সনের ৪ঠা শা’বান মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন।মদীনা শরীফ ত্যাগপুর্বক মক্কা শরীফে গমণের কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণের মত,মূলত ইয়াযিদ যে কার্যক্রম শুরু করেছিলো এবং শেষ পর্যন্ত সম্মানিত সাহাবীগণ ও আহলে বাইতগণের প্রতি তার যে মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছিলো তাতে তিনি মদীনা শরীফে ফিৎনা ফাসাদের আশংকা করছিলেন। তাই বিশিষ্ট সাহাবীগণ ইতিপূর্বেই মদীনা শরীফ ত্যাগ করেন।দ্বিতীয়ত, সাইয়্যিদুনা ইমাম আলাইহিস সালাম তিনি আশা করেছিলেন, মক্কা মুকাররমা শান্তি ও নিরাপত্তার শহর হিসেবে উনার জন্য নির্দিষ্ট হবে।

কেননা আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “ওয়া মান দাখালা কা -না আ -মানা।” অর্থাৎ, যে হেরেম শরীফে প্রবেশ করলো,সে নিরাপত্তা পেয়ে গেলো। (সুরা আলে ইমরান শরীফ -আয়াত ৯৭) উক্ত আয়াতে কারীমার ভিত্তিতে হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে ঝগড়া-ফাসাদ,খুন -খারাপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি হেরেম শরীফের সীমানায় ক্ষতিকর প্রাণী যেমন সাপ,বিচ্ছু ইত্যাদি ছাড়া কোন প্রাণী হত্যা নিষেধ। আর মু’মিনদের শান,মান,মর্যাদা তো অনেক উর্ধ্বের ব্যাপার। তাই হজরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম চিন্তা করেছিলেন যে, নিশ্চয়ই ইয়াযিদ হেরেম শরীফের পবিত্রতার কথা বিবেচনায় এখানে সকল প্রকার অন্যায় অপকর্ম থেকে বিরত থাকবে। এই মনোভাব নিয়ে তিনি মক্কা শরীফ চলে আসেন।

এমনও হতে পারতো যে, হযরত ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম বাকি জীবন হেরেম শরীফে অবস্থান করে আল্লাহ্ পাক উনার ইবাদত-বন্দেগি ও দ্বীনি তালীম -তালকীনে কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু মহান আল্লাহ্ পাক উনার পক্ষ থেকে কী ঘটবে তা-ই আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই।