হারিয়ে যাচ্ছে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সেই টালি শিল্প

আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিতে নানান জটিলতা, অর্থাভাব আর বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী টালি শিল্প। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে পৌর এলাকার মুরারিকাটি ও শ্রীপতিপুর এলাকায় ৪১টি কারখানার মধ্যে সচল আছে মাত্র ৭টি। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪ হাজার শ্রমিকের অবস্থা করুণ।

টালি কারখানার মালিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি ও কলারোয়া ক্লে টাইলসের মালিক গোষ্ট চন্দ্র পাল জানান, ‘পূর্ব পুরুষদের পেশা অনুযায়ী এখানকার পালরা মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি করতেন। এই প্রতিমা তৈরি করে মুরারিকাটি ও শ্রীপতিপুর এলাকার পাল বংশের লোকরা সারা দেশে সুখ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে সেই মাটি দিয়ে এখানে নানান নকশার টালি ও টাইলস টালি তৈরি করে বিপ্লব আনেন। কয়েক বছর আগে সেই টালি শিল্প এতোটাই সুখ্যাতি অর্জন করে যে, এখানকার টালি নিয়মিত রপ্তানি হতো ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। একে একে গড়ে ওঠে ৪১টি বিশাল টালি কারখানা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে নানান প্রতিকূলতা আর সহযোগিতার অভাবে ধংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায় সেই ঐতিহ্যবাহী টালি শিল্প।’

কলারোয়া উপজেলার কয়লা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়াররম্যান আবুল হোসেন মেম্বার জানান, ‘২০০০ সাল থেকে এখানে টালি নির্মাণ শুরু হয়। ২০০২ সালে ইতালির ব্যবসায়ী রাফাইলো আলদো আসেন বাংলাদেশে। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নারায়ণগঞ্জে টালি তৈরির কাজ শুরু করেন। ওই এলাকার তৈরি টালি পছন্দসই না হওয়ায় তিনি আবার নিজ দেশে ফিরে যান। ওই কোম্পানির ম্যানেজার রুহুল আমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পোড়া মাটির টালি তৈরির জন্য মাটি খুঁজতে খুঁজতে কলারোয়ার কুমারপাড়ায় এসে পেয়ে যান তার মনমতো মাটি। পরবর্তীতে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট প্রা. লি.-এর মালিক রুহুল আমিন কলারোয়া কুমোরদের প্রথম মাটির তৈরি টালির সম্ভবনার পথ দেখান। শুরুতেই পাঁচটি কারখানার উৎপাদিত সেই টালি ইতালিতে রফতানি হতো। সেখানে একে একে গড়ে ওঠে বহু টালি কারখানা। এ কারণে এই এলাকা ইতালিনগর বলেও পরিচিত হয়ে ওঠে।’

তিনি আরো জানান, ‘দুই বছর যেতে না যেতেই এখানকার উৎপাদিত টালি নজর কাড়ে জার্মান, দুবাই, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের। মংলা বন্দর দিয়ে কলারোয়ার উৎপাদিত টালি চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিনিময়ে দেশে আসে বৈদেশিক অর্থ। আস্তে আস্তে টালির চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখানে বৃদ্ধি পেয়েছিল এখানকার টালি তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় প্রায় চার হাজার শ্রমিকের। ২০১০ সাল পর্যন্ত টালি শিল্পের মালিকদের সুদিন ছিল। প্রতিটি টালি ৩০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করতেন ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর এই টালি শিল্প থেকে ৩০০ কোটিরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো।’

কলারোয়া টালি সমিতির সভাপতি গোষ্ট চন্দ্র পাল বলেন, ‘১ কন্টেইনারে ১৫ হাজার পিস টালি বোঝায় করা হয়। এমনও হয়েছে যে, মাসে ৩০ কন্টেইনারেরও বেশি টালি ইতালিতে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে যা নেমে এসেছে ৪ থেকে ৫ কন্টেইনারে।’
তিনি আরো জানান, ‘প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে টালি তৈরির মৌসুম শুরু হয়ে চলে মে মাসের শেষ পর্যন্ত। বর্তমানে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় অনেকখানি ক্ষতির মুখে পড়ে অনেক ব্যবসায়ী টালি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।’

স্থানীয় অনেক টালি শ্রমিক জানান, ‘এক একটি পোনের টালি সাজানোর মধ্যেই নতুন নতুন স্বপ্নকে সাজায় এই টালি শ্রমিকরা। আজ সেই স্বপ্ন হারিয়ে যেতে বসেছে। এই টালি শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি।’

এই ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘প্রতি কন্টেইনার টালির উৎপাদন খরচ প্রায় এক লক্ষ টাকার বেশি। ইউরোপের বাজারে যার মূল্য দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা। বছরে প্রায় ৪০০ কন্টেইনার টালি রফতানি করে শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্র অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মালিকদের অসম প্রতিযোগিতার কারণে এ শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এই টালি ব্যবসা।’

ব্যবসায়ী আবুল হোসেন মেম্বার বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়ন প্রকল্পে ও বিভিন্ন সরকারি ভবনে এই টালি ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যেখানে দেশের তৈরি টালি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে আর সেখানে আমাদের দেশের কিছু অসাধুদের ব্যক্তিস্বার্থে দেশের কাজে ব্যবহারের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে থেকে এই টালি আমদানি করছে। গুণগতমান বিচারে আমদানিকৃত ভারতীয় টালির তুলনায় কলারোয়ার তৈরি টালি অনেক গুন বেশি ভালো। যদি এই টালিগুলো আমদানি বন্ধ করা যায় তাহলে লাভবান হবে দেশের ব্যবসায়ীরা, দূর হবে এই এলাকার বেকারত্ব। পাশাপাশি টিকে থাকবে এই টালি শিল্প।’
এ বিষয়ে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, কলারোয়ার টালি শিল্পের অনেক সুনাম রয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশে। এই টালি শিল্পে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল। একটা সময় এই টালি শিল্প বিদেশে রপ্তানি করে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। সময়ের সাথে সাথে কলারোয়ার ঐতিহ্য এই টালি শিল্প এখন প্রায় ধ্বংসের পথে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারি সহযোগিতা। স্বল্প সুদে ঋণ পেলে ব্যবসায়ীরা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে এই শিল্পকে। এই এলাকার অনেক মানুষের আবারো নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে বিশ্বাস করি।’