বিদেশি কার্টুনে কী শিখছে শিশুরা

শিশুর কাছে কার্টুন সবচেয়ে প্রিয় বিনোদন। কার্টুনে শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। যা শিশুর বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বিদেশি কার্টুনে কী শিখছে শিশুরা? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাসুমা রুমা

শৈশব কাল মানুষের হাতেখড়ির সময়। এ সময়ে শিশুদের যেভাবে গড়ে তোলা হয়; তার প্রভাব পরবর্তী জীবনের মানদণ্ড নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে। বর্তমান সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবিকতার চেয়ে পুঁজিবাদী মনোভাবের প্রাধান্য বেশি। শিশুদের মানসিক বিকাশের স্বার্থে আমরা অনেক মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে থাকি। এ মাধ্যমগুলোর মধ্যে কার্টুন শিশুদের কাছে অধিক জনপ্রিয়।

দেশীয় কার্টুন হিসেবে ‘মীনা’ সুনাম অর্জন করেছে। আমরা অধিকাংশ মানুষই শৈশবে মীনা কার্টুনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। যেখানে গল্পে গল্পে শিক্ষণীয় ও মূল্যবান তথ্য ফুটিয়ে তোলা হতো। এখন আর মীনা আর রাজুকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখাই যায় না। হঠাৎ দেখা গেলেও পুরনো পর্বগুলোই প্রচার করা হয়।

স্যাটেলাইট চ্যানেলের বদৌলতে এ দেশে অসংখ্য বিদেশি কার্টুন প্রচার করা হচ্ছে। এসব কার্টুন বর্তমানে শিশুদের কাছে ভালো লাগার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে শিশুদের ওপর বিদেশি কার্টুনের প্রভাব কতটুকু তা উপলব্ধি করা যায়।

প্রথমত, বিদেশি কার্টুনগুলো বিদেশি সংস্কৃতির ধারক। শিশুরা যেহেতু অনুকরণপ্রিয় এবং শৈশবে তাদের মন ও মস্তিষ্ক অনেক বেশি কোমল থাকে, তাই বিদেশি সংস্কৃতিকে শৈশব থেকেই তারা নিজেদের সংস্কৃতি বলে অন্তরে লালন করতে শুরু করে। কার্টুনে দেখানো কথা-বার্তা, চিন্তা-চেতনা, পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুর প্রভাব পড়ে শিশুর মানসিক বিকাশে। শিশু যখন বড় হয়ে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠবে; তখন নিজ সংস্কৃতি মেনে নিতে তারা অনেকটাই কুণ্ঠাবোধ করবে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগবে। দেশীয় সংস্কৃতিকে তারা যতই অন্তরে লালন করার চেষ্টা করুক না কেন শৈশব থেকে শিখে আসা বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব থেকেই যাবে। ফলে পরবর্তী জীবনে বিষয়গুলো বিপত্তির কারণ হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কার্টুনগুলোতে অনেক মিথ্যা কথা, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত বিষয় তুলে ধরা হয়, যা শিশুদের মধ্যে ধীরে ধীরে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। অনেক শিশুকেই আমি বলতে শুনেছি, ‘মিথ্যা বলা দোষের কিছু না।’ কারণ কার্টুনে সে মিথ্যা বলতে শুনেছে, কেউ তাদের বকে না। সুতরাং শিশুরা মিথ্যা বলাকে সহজ বলে মেনে নিতে শেখে এবং তার অঘোষিত স্বীকৃতিও পেয়ে যায়। এসব শিশুকে নিয়ন্ত্রণ করা অভিভাবকদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত, কার্টুন শৈশব থেকে অনেক মূল্যবান সময় কেড়ে নেয়। শৈশব হলো শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের সময়। শৈশবকে অবহেলা করে সময় পার করে দিলে পরবর্তী জীবনে ভুক্তভোগী হতে হয়। শিশুদের মানসিক বিকাশে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা অনেক। কার্টুন দেখার সময়টুকু শিশুদের জন্য তখনই ফলপ্রসূ হবে; যখন সেখানে ভালো গল্প, কাহিনি, শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হবে।

কিন্তু আজকাল যেসব কার্টুন প্রচার করা হয়, যেমন- ডোরেমন, মোটু-পাতলু, টম অ্যান্ড জেরির মতো অসংখ্য বিদেশি কার্টুনে ভালো কিছু শেখানো হয় না। বরং কার্টুন দেখার সময়টুকু যদি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করা যায়, তাহলে শিশুরা কিছু শিখতে পারবে। যাকে আমরা পারিবারিক শিক্ষা বলতে পারি। শিশুদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের মায়া-মমতা, ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হবে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। শিশুরা আদর্শ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাবে।

অর্থহীন বিদেশি কার্টুনের লাগামহীন প্রচার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুর মানসিক বিকাশের স্বার্থে দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ন রেখে মানসম্মত দেশীয় কার্টুন নির্মাণ করতে হবে। এতে শিশুরা অনেক কিছু শিখতে পারবে এবং বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি তাদের আগ্রহও কমে যাবে।

তাই অভিভাবকদের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। বিদেশি কার্টুন দেখা থেকে শিশুদের বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে অন্য কোনো ভালো মাধ্যমের দ্বারা শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে শিশুদের নিজস্বতা হারিয়ে যাবে, লাভ হবে পুঁজিপতিদের।