খাগড়াছড়ি মানিকছড়ি-ফটিকছড়ি সীমান্তে মগপার্টির ৫ সন্ত্রাসী আটক,বিপুল অস্ত্র উদ্ধার

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মানিকছড়ি উপজেলা-ফটিকছড়ি সীমান্তে বিপুল পরিমান অস্ত্র, গুলি, মাইন তৈয়ারীর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ‘মগপার্টি’ নামধারী ৫জন উপজাতি সন্ত্রাসীকে।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভিত্তিতে গুইমারা রিজিয়নের তত্ত্ববধানে সিন্দুকছড়ি জোন কর্তৃক বটতলী, দক্ষিণ কাঞ্চননগর এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে সেনাবাহিনীর একটি দল। খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি-ফটিকছড়ি, সীমান্তে দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে একটি উপজাতিয় সন্ত্রাসী গ্রুপ এমন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারী) ভোর রাতে সিন্দুকছড়ি জোনের আওতাধীন বড়তলী এলাকায় রমজান আলীর বাড়ীতে অবস্থান নেন উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ এমন খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর ২৪আর্টিঃ বিগ্রেড গুইমারা কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো: কামাল মামুন এর নির্দেশে অভিযান পরিচালনা করেন তিন ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি সিন্দুকছড়ি জোনের সেনা সদস্যরা অভিযান চালায়।

বর্ণিত অভিযানে ৫জন পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী আটকসহ বিপুল পরিমাণে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং আইইডি সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, ৭৩রাউন গুলিসহ মাইন তৈয়ারীর সরঞ্জাম উদ্ধার করেন।

সেনাবাহিনীর দেয়া বিবরণ অনুযায়ী সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে- ১টি একে-৪৭ রাইফেল(৭ রাউন্ড এ্যামোনিশন এবং ১টি ম্যাগাজিনসহ, ১টি এম-১ রাইফেল(২৪ রাউন্ড গুলি ভর্তি ম্যাগাজিনসহ), ১টি একে-২২রাইফেল(আনুমানিক ২০০রাউন্ড এ্যামোনিশনসহ), ৪টি মর্টার, ১টি ৭.৬৫মি.মি. পিস্তল-চায়না(৩রাউন্ড এ্যামোনিশনসহ), ১টি এলজি লং ব্যারেল রাইফেল(৩৬টি এলজি কার্তুজ), ১টি এলজি সর্ট ব্যারেল রাইফেল, বিপুল পরিমাণ আইইডি সরঞ্জামাদি এবং ব্যবহৃত ইউনিফর্ম।

অস্ত্র উদ্ধার করা হয় এই ব্যাপারে ফটিকছড়ি থানার এসআই আলমগীর বলেন গোপন সংবাদ ভিত্তিতে বিপুল অস্ত্র ও ৫জন সন্ত্রাসীদের আটক করা হয়। তাদের বিরদ্ধে অস্ত্র আইনের মামলার রুজু করা হয়েছে। এসময় মানিকছড়ি সাব-জোনের আওতাধীন বটতলী এলাকার রমজান আলীর বাড়ি থেকে অস্ত্র ও গোলা বারুদসহ পাঁচ সন্ত্রাসীকে আটক করে সেনা সদস্যরা।
জানা গেছে, জনৈক রমজান আলীকে জিম্মি করে গত তিনদিন ধরে তার বাসায় সন্ত্রাসীরা অবস্থান নিয়ে এ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছিল সন্ত্রাসীরা।

পরবর্তীতে আটককৃত ব্যক্তিবর্গকে এবং উদ্ধারকৃত সরঞ্জামাদি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার তিনটহরী ইউনিয়ন এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী জনপদ দুইল্যাছড়ি ও বটতলীর গহিন অরণ্যে শুক্রবার ভোর রাতে অভিযান পরিচালনা করেন গুইমারা রিজিয়নের সেনাসদস্য ও ফটিকছড়ি থানা-পুলিশের সদস্যরা।

টানা ১০ঘণ্টার অভিযানের পর শনিবার ফটিকছড়ির বটতলী থেকে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদসহ পাঁচ ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) কাজী মাসুদ ইবনে আনোয়ার।
আটক ব্যক্তিরা মগ লিবারেশন পার্টির সদস্য বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দুইল্যাছড়ি ও বটতলী গহিন অরণ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র অবস্থানের গোপন তথ্য পেয়ে গতকাল(শুক্রবার) রাত সাড়ে তিনটায় অভিযান চালানো হয়। এতে গুইমারা রিজিয়নের সিন্দুকছড়ি ও ল²ীছড়ি জোনের সেনাসদস্য এবং ফটিকছড়ি থানা-পুলিশ অংশ নেয়। শনিবার বেলা ১১টার পর ফটিকছড়ির বটতলীর নির্জন একটি বসতঘরে লুকিয়ে থাকা মগ লিবারেশন পাটির পাঁচ সদস্যকে আটক করা হয়। এ সময় ওই ঘরের চৌকির নিচে স্তুুপ করে রাখা বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়।
পুলিশ আরও জানায়, জব্দ করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে আছে একটি একে ৪৭, চারটি মর্টার, একটি পয়েন্ট ২২মিলিমিটার রাইফেল, একটি এম-১ আগ্নেয়াস্ত্র, পাঁচ জোড়া ইউনিফর্ম, একটি চাইনিজ পিস্তল, একটি এলজি শর্ট ব্যারেল, ৩৬টি এলজির গুলি, সাতটি একে ৪৭-এর গুলি, ২৪টি এম-১ গুলি, ছয়টি মোবাইল ফোনসেট, দুটি ওয়াকিটকি, ভারতীয় মুদ্রা, মাইন তৈরির সরঞ্জামসহ বিভিন্ন জিনিস।

ফটিকছড়ি থানার ওসি কাজী মাসুদ ইবনে আনোয়ার জানান, দুপুর সাড়ে ১২টায় আটক সন্ত্রাসী ও জব্দ করা আগ্নেয়াস্ত্র মানিকছড়ি সেনা ক্যাম্পে আনা হয়। সেখানে আটক ব্যক্তিদের এবং উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদের ছবি ও বিবরণ উপস্থাপন করা হয়। তবে এখনো আটক ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অভিযানে আটক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাসহ পরবর্তী কার্যক্রম চলমান অব্যাহত রয়েছে।

পুলিশ ও সেনাবাহিনী আটককৃতদের নাম ও ঠিকানা জানাতে না পারলেও স্থানীয় সূত্রে তিন জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন-১. প্রদীপ মারমা(২৬), পিতা-মৃত আপ্রুসি মারমা, গ্রাম-দাজ্যা পাড়া, মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি, ২. উষাজাই মারমা(১৯), পিতা-ক্যচিং মারমা, গ্রাম-ঐ; ৩. চহ্লা মারমা(২৪), পিতা-কংক্য মারমা, গ্রাম: ঐ। বাকী ২জনের নাম জানা যায়নি।

দুপুর সাড়ে ১২টায় আটককৃত ৫ সন্ত্রাসীকে মানিকছড়ি সেনা ক্যাম্পে আনা হয়। সেখানে সন্ত্রাসী ও উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ছবি ও বিবরণ উপস্থাপন করা হলেও সন্ত্রাসীদের নাম, ঠিকানা নিশ্চিত করতে পারেনি সেনাবাহিনী। বিকেলে ফটিকছড়ি পুলিশ সন্ত্রাসীদের নাম, ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে গণমাধ্যমে জানাবেন বলে জানানো হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি সিন্দুকছড়ি জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ পারভেজ মোস্তফা পিএসসি,জি।
উল্লেখ্য যে, গত ১৯শে জানুয়ারি বিকেল থেকে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার কয়েকটি স্থানে মগপার্টি নাম দিয়ে সশস্ত্র তৎপরতার খবর দেয় এলাকাবাসী। এ নিয়ে বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে ‘মানিকছড়িতে “মগপার্টি” নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠির তৎপরতা শুরুর অভিযোগ’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হলে পরে সন্ত্রাসী দলটি সেখান থেকে অন্যত্র সরে যায়।

আরো জানা গেছে, প্রায় মাসখানেক ধরে উক্ত সন্ত্রাসী গ্রুপটি ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নে অবস্থিত বনবিভাগের ধুরুং বিট-এর বাগানের গাছ সাবাড় করার কাজে লৌহা কামাল নামে এক সেটলার বাঙালির ভাড়াটে হিসেবে গাছ কাটার শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়ার কাজ করে আসছিল। মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যছোলা ইউনিয়নের সাপমারা এলাকার বাসিন্দা লৌহা কামাল এই সন্ত্রাসী গ্রুপটিকে ভাড়া করে বটতলী এলাকায় নিয়ে যায় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। লৌহা কামাল গংদের মধ্যে বাবুল নামে ফটিকছড়ির এক গাছ ব্যবসায়ীর নামও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে গত ২৪শে ফেব্রæুয়ারি বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে ’বনবিভাগের ধরুং বিটের বাগান সাবাড় করছে সেটলার-মুখোশরা, বনবিভাগ অসহায়’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।

স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, কথিত ‘মগপার্টি’ নামধারী উক্ত সন্ত্রাসীদের সাথে নব্যমুখোশ বাহিনীরও যোগসাজশ রয়েছে। এই সন্ত্রাসী গ্রুপটির নেতৃত্বদানকারী হিসেবে কংচাইঞো মারমা নামে একজনের নাম পাওয়া গেছে, যিনি নব্যমুখোশ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তার বাড়ি গুইমারার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের গরিয়াছড়ি গ্রামে।

গত বছর ৫ই এপ্রিল মানিকছড়ির যোগ্যছোলা ইউনিয়নের খাড়িছড়া এলাকা থেকে মো: আব্দুল কাদের প্রকাশ মগ্যা কাদের(৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণের ঘটনায় কংচাইঞো মারমা জড়িত বলে জানা যায়। অপহৃত ব্যক্তির কোন খোঁজ মিলেনি।

এর আগে ২০২১সালের ১লা ডিসেম্বর মানিকছড়ি উপজেলার তিনটহরী ইউনিয়নের একসত্যাপাড়া থেকে ইমান হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণের ঘটনায়ও ‘মগপার্টি’ পরিচয়দানকারী সন্ত্রাসী গ্রুপের হোতা কংচাইঞো মারমার গং জড়িত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সে সময় অপহৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে তারা মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

পরবর্তীতে উক্ত অপহরণ ঘটনাগুলোর সত্যতা প্রকাশ পেলে কংচাইঞো মারমা দলবল নিয়ে বান্দরবানে পালিয়ে যায়। সেখানেই মগপাটির একটি অংশের সাথে তার যোগাযোগ হয় বলে একটি সূত্রে জানা যায়। পরে মগপাটির ওই অংশের কাছ থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবরুদ ক্রয় করে এ বছর জানুয়ারি মাসে মানিকছড়িতে ঢুকে নব্যমুখোশ বাহিনী ও আওয়ামীলীগের কতিপয় নেতার যোগসাজশে সশস্ত্র তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।