দেশে ব্যাংকের সংখ্যা মোটেও বেশি না : ড. ফরাসউদ্দিন

ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা যা ভাবছি, যা বলছি, তার চেয়ে অনেক বেশি অবদান রাখছে। ভুল ধারণার কারণে অনেকে বলছেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এ কথা একদম অর্থহীন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন এমন মন্তব্য করেন।

শুক্রবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে ‘আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও মান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

সাবেক এই গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত যে পরিমাণ অবদান রাখছে তা সত্যিই অনস্বীকার্য। সেই পরিমাণ স্বীকৃতি আমরা তাদের দেই না- এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা যা ভাবছি, যা বলছি, তার চেয়ে অনেক বেশি অবদান রাখছে। ভুল ধারণার কারণে অনেকে বলছেন, ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এ কথা একদম অর্থহীন।

তিনি বলেন, ভারতে একটি ব্যাংকের ৬০০টি শাখা আছে। আমাদের দেশে কোনো কোনো ব্যাংকের এখনও ১০ থেকে ১৫টার বেশি শাখা নেই। কাজেই অর্থহীন একটি কথা ব্যাংকের সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক নয়।

বাংলাদেশে ব্যাংকের শাখা বেশি কি না- সেটা দেখেন। বাংলাদেশের একটি ব্যাংক যে পরিমাণ লোককে সেবা দেয় সেটি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার চেয়ে অনেক কম। শুধু কম নয়, অনেক কম। তাই ব্যাংকের সংখ্যা দিয়ে কিছু হয় না।

তিনি বলেন, অনেকে বলছেন, প্রাইভেট ব্যাংক ভালো করছে, সেটা সেবার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের প্রাণ কৃষি। এ ক্ষেত্রে কয়টি প্রাইভেট ব্যাংক লোন দিয়েছে? অথচ সোনালী বা অগ্রণীর কাছে এমন অসংখ্য হিসাব আছে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যদি ব্যাংক হয় তাহলে ব্যাংকের মতো সেবা দিতে হবে।

সোনালী ব্যাংক বাদে বাকি ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংক আমাদের ট্রেডার। সোনালী ব্যাংক রেখে বাকি সব ব্যাংক বেসরকারি করে দিতে হবে। বিক্রি করা যায় কি না- দেখতে হবে। তবে আমরা দেখেছি, রূপালি ব্যাংক বিক্রি করতে গিয়ে মহা ঝামেলায় পড়তে হয়।

তাই এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অভিহিত মূল্যে শেয়ারগুলো মূলধন মার্কেটের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে বিক্রি করে দিতে হবে। যদি অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যেও বিক্রি করতে হয়, তাও ভালো; জনসাধারণ কিন্তু ব্যাংকের মালিক হয়ে গেল। তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, কোনো রকম কারচুপির মাধ্যমে এ শেয়ার যেন বিত্তবানরা কিনে নিতে না পারেন।

দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে ব্যাংকের অর্থয়ানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত থেকে লংটার্ম প্রজেক্টে (দীর্ঘ মেয়াদের প্রকল্পে) বিনিয়োগ বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও নেই। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশেও এ ধারাই ছিল। ১৯৯২-৯৩ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শে সরকার একটি বড় ধরনের আইন আনলো। বাণিজ্যিক ব্যাংককে বাধ্য করা হলো লংটার্ম বিনিয়োগে।

ব্যাংকের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদের অর্থায়ন না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের ডিপোজিট (আমানত) অত্যন্ত কম। হিসাব করে দেখলে দেখা যাবে, মোট আমানতের তিন ভাগের এক ভাগ এফডিআর (স্থায়ী আমানতে), বাকি আমানত একদিন বা এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিতে হয়। ব্যাংক যদি এক বছর, দুই বছর বা পাঁচ বছরের জন্য টাকা দেয় তাহলে আটকে গেল।

আমি আশা করি, কোনোদিন বাংলাদেশ সরকার, সমাজের বিজ্ঞ মহল, আর্থিক মহল বিষয়টি বুঝবে এবং এ রাস্তা থেকে বের হয়ে আসবে। বের হওয়ার রাস্তার জন্য ক্যাপিটাল মার্কেটকে স্থিতিশীল করতে হবে। বন্ড মার্কেট বড় করতে হবে। বীমা ফান্ড অলস পড়ে না থেকে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে’- বলেন সাবেক এ গভর্নর।

ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর)-এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এডি রেশিও নিয়ে যে নিয়ম রয়েছে তা পালন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে একসময় বাপ-দাদার নাম ভুলে যাওয়ার অবস্থা হতো। কিন্তু এখন এডি রেশিওর নিয়ম পরিপালন না করলেও কোনো সমস্যা হয় না। কিছুদিন আগে এডি রেশিও দশমিক ৭ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫-এ নিয়ে আসা হয়েছিল। এরপরও ২৫টি ব্যাংক তা পরিপালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তারা ব্যর্থ হয়েছে।

ফরাসউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউসিবি ক্যাপিটাল লিমিটেডের রাজিব কুমার।

এস কে সুর চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি রয়েছে তবে এটি অচিরেই ঠিক হয়ে যাবে। তারল্য সমস্যা এটি মাঝেমধ্যেই দেখা দেয়। আমানত কমে যাচ্ছে, ঋণ বিতরণ বেড়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগের অর্থ সংগ্রহের জন্য পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, বন্ড মার্কেটকে ডেভেলপ করতে হবে এবং করপোরেট বন্ড ইস্যু করতে হবে।

তিনি বলেন, বন্ড মার্কেট উন্নয়নে সরকার একটি কমিটি করেছে। এটির কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বন্ড মার্কেটে কিছু বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে, বিশেষ করে করপোরেট বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় এনবিআরের করের চাপ। এটি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তিনি একমত হয়েছেন।