পাক হানাদার ও এদেশের দোষরদের বর্বরতা আমার বেঁচে থাকার গল্প

২ জুলাই ২০২১, আজকের দিনটিকে আমি আমার পুনঃজন্মদিন ভেবে ভীষনভাবে স্মরন করি ১৯৭১ এর ২ জুলাই এর সেই ভয়াবহ দিনটি। ওইদিন আমি পাকিস্তানি আর্মিদের গুলি থেকে আশ্চার্যজনকভাবে বেঁচে যাই। দিনটি ছিলো শুক্রবার।
কয়েকদিন ধরে একটানা অনবররত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। সময় ছিলো দুপুর ১:৩০। আমাদের বাড়ির মসজিদ, বালিয়াডাঙ্গা জামে মসজিদে (সাতক্ষীরা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে) জুম্মার নামাজ আদায় করছি। হঠাৎ করে কিছু পাকিস্তানি আর্মিসহ কুলিয়ার কুখ্যাত ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল গফফার সরদার মসজিদের গেইটের সামনে হাজির। তখনই ব্যাপারটা না বুঝবার কিছুই থাকলো না। কারণ সরদার বাড়ী ওইদিন পাকিস্তান আর্মিরা আক্রমণ করবে এটা আমাদেরকে পূর্বে জানানো হয়েছিলো। শুধু তাই নয় আমার আব্বা আমার মা’কে বলেছিলেন যে নীলটু (নীলটু নূরুল রইছ) যেনো দুপুরের খাবার পর বাড়ির পূর্ব পাড়ার দিকে গিয়ে পালিয়ে যায়। জুম্মার দিনে মসজিদে নামাজ আদায় করার মুসল্লীর সংখ্যা যথেষ্ট কম থাকার কারণে মা’ আমাকে বললো যে নামাজ পড়তে যাও। নানা অজুহাত দেখাতে লাগলাম না যাওয়ার জন্য। সত্যি কথা বলতে কি আব্বা যে বলেছিলেন দুপুরের খাওয়ার পর পূর্বপাড়ার দিকে চলে যেতে সে কথা বেমালুম ভূলে গিয়েছিলাম। মা’র সামনে আব্বার কথাটাও বলতে ভূলে গিয়েছিলাম। কি আর করবো অগত্তা মসজিদে যেতে হলো।

যাইহোক স্থানীয় দালালসহ পাক আর্মি যখন সামনে, ভাবতে শুরু করলাম কিভাবে পালানো যায়। একপর্যায়ে মসজিদের সব মুসুল্লীদের একসাথে হাতবেঁধে মসজিদের বাইরে দাঁড় করানো হয়। এরপর আবার বাছাই করে চাচা মরহুম আব্দুস শহিদ সরদার (তৎকালিন ইউ পি সদস্য), চাচা মোশাররফ হোসেন (যশোর এম এম কলেজে অধ্যায়নরত), চাচাতো ভাই নুরুজ্জামান টুনু (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে কর্মরত) চাচাতো ভাই মনিরুজ্জামান টুকু (বাড়ীতেই থাকতেন) ও আমি (ঢাকার আইডিয়াল কলেজে অধ্যয়নরত) এই কজনকে রেখে বাকি আর সবাইকে ছেড়ে দেয়। বলে রাখা ভালো চাচাতো ভাই মনিরুজ্জামান টুকু স্বইচ্ছায় সব কিছু জানার পরও পাক আর্মির সামনে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে যেয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হলো। এর কারণ কথিত আছে বালিয়াডাংগার আব্দল গফুর (গফফার চেয়ারম্যানের গোয়েন্দা) পাক আর্মিকে বলেছিলো যে ‘স্যার ও আদমী ডাকু হ্যায়’। এরপর আমাদের দলভুক্ত হয়ে সংখ্যায় পাঁচ এ দাড়ালো। তারপর ওকে (টুকু ভাই) যাওয়ার পথে প্রচুর পরিমানে মেরে ছিল। আমাকেও আমার বাম চোয়ালে স্বজোরে চড় মেরে ছিলো। সেখান থেকে আমি বাম কানে কম শুনি। এইবার পাক ট্রাকে উঠার পালা। সবাইকে এক এক করে উঠালো। উঠে দেখি গাড়িতে আরো ৭/৮জন পাশের গ্রাম শ্রীরামপুর থেকে ধরে এনেছে। ওদেরকে ওখানেই কুলিয়ার খান বাহাদুর মোবারক আলী ব্রীজের নীচে লাবন্যবতী নদীর তীরে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। ওদের মধ্যে একজনকে এতটা মেরেছিল যে ট্রাক থেকে নদীর কিনারা পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা ছিলনা। তাকে টানতে টানতে ১০/১২ হাত দূরে নেয়ার পর ওর মুখে বরাবর গুলি করে বাকিদের নদীর কিনারায় নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলো। তখনো আমার আব্বা পাগলের মতো আর্মির গাড়ীর পাশ দিয়ে একবার উত্তর একবার দক্ষিণ দিক হাটাহাটি করেছে। এক পর্যায়ে শহীদ চাচা হঠাৎ ওনার হাত ঘড়িটি খুলে আমার আব্বার হাতে দিয়ে বলেন ‘বড়ভাই এটা আনছারের মা’র (শহিদ চাচি) হাতে দিয়ে দেবেন আর ওদেরকে ভালোভাবে চালতে বলবেন’। হয়তো চাচা বুঝতে পেরেছিলেন কি ঘটতে যাচ্ছে! চাচা গাড়ীতে আমাদেরকে বলেছিলেন ওরা আমাকে মেরে ফেলবে! তাই হলো। এদিকে টুনুভাই মোটামুটিভাবে উর্দু কথা বলতে পারতো। তাছাড়াও সরকারী কর্মচারী হওয়ায় ওকে ছেড়ে দিল।

অপরদিকে কবীর চাচা গফফার সরদারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার ভাই মোশারফ চাচাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। ঠিক সেই মূহুর্তে পায়ে জড়িয়ে ধরে মোশারফ চাচাকে বলি আমার জন্য কবীর চাচাকে একটু বলো! কবীর চাচার উত্তর শুনে মোটামুটি কষ্ট পেলেও প্রানে বাঁচার একটা পথ হয়েছিল যা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ মোশারফ চাচাও আমাকে এক দড়িতে বাধা হয়েছিল। ওকে ছাড়িয়ে নেয়ার পর পাকআর্মিদের সাথে থাকা এক বাঙালী আর্মিকে অনুরোধ করলাাম আমাকে দড়ি দিয়ে না বেঁধে দড়িটা পেচিয়ে হাতের ওপর রেখে দিন। সে তাই করলো। আরও বললাম আমাকে একটু বাঁচাবার চেষ্টা করেন। তখন বাঙালি আর্মি আমাকে বললো, ‘দেখছেন না এত মানুষদের গুলি করে মারছে আর আমি শুধু উর্দুতে গান গাচ্ছি, ওরা যদি আমার একটু মন খারাপ দেখে তাহলে আমাকেও ওরা গুলি করে মারবে। তার চেয়ে ওরা যদি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে আপনি বলবেন কলেজে না বলে বলবেন আমি এসএসসি পরীক্ষা দেব। উনি আরও বল্লেন জাতি সংঘ থেকে চাপ দিচ্ছে এখানে ছাত্রদের পরীক্ষাসহ সব কিছুই স্বাভাবিক চলার। তাই এই কথা বললে হয়তো ছেড়ে দিতে পারে’। কথাটা ঠিকই ছিল কিন্তু ওরা জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলতে পারিনি। কি কারণে আমাদেরকে ধরা হয়েছে তার একটা অল্প কথায় লিখতে হলে প্রথম শহিদ চাচার অপরাধ হলো তার চাচাতো ভাই আজিয়ার রহমান ওরফে আজু কুখ্যাত রাজাকার গফফার সরদারের বাড়ী থেকে যে সমস্ত গরু মহিষ নিয়ে ভারতে চলে গেছে তার সব দ্বায় চাচার (শহিদ চাচা) ওপরে বর্তালো। এবার আমার অপরাধ হলো যে আমি শান্তি কমিটির কাজের ওপর বাধা দিতে থাকি।

আামাদের পাশের গ্রাম কুলিয়ার পূর্ব পাড়ার মনমোহন্তো পালের কিছু নৌকা শান্তি কমিটির লোকেরা নিয়ে যেতে চাইলে আমি বাধা দেই এবং পরে নৌকাগুলো পানিতে ডুবিয়ে রাখি। এছাড়াও হিন্দু মুসলিমরা (বিশেষ করে হিন্দুরা) যখন প্রাণভয়ে সাথে থাকা শেষ সম্বল নিয়ে ভারতে পালাতো, তখন শান্তি কমিটির ও এক শ্রেণির লোকেরা লুটপাতে মেতে উঠতো। সেগুলো আমি চরমভাবে বাঁধা দিতাম। আর আমার সব ভাই বোন ভারতে চলে যায় পাক আর্মির ভয়ে। এই কথাগুলো গফফার সরদার (কুখ্যাত রাজাকার) সরাসরিই আমাকে না চিনে জিজ্ঞেস করলো ‘তোমার আব্বার নাম কি’? নাম বলার সাথে সাথে বললো, না খোকা তোমাকে ওরা ছাড়বে না। তুমি ওদের হয়ে এখানে কাজ করছো। সে সব খবরই পাক আর্মিরা জানে। আমার সম্মন্ধে সব খবরই পাক আর্মিদের কাছে পৌছে যেতো আমাদের বাড়ির কিছু দালালের জন্য। আর টুকু ভায়ের অপরাধ ও নাকি ডাকাত!

সেই সময়ের অবস্থা একবার ভাবলে সমস্ত শরীর শীউরে উঠে। পাক আর্মিরা ফিরে এসে গাড়ীতে উঠলো। এসেই প্রথম আমাকে জিজ্ঞাসা করলো তোম কিয়া ক্যারতা হ্যায়? বল্লাম পড়তা হ্যায়, কিদার পড়তা হ্যায়? বল্লাম ঢাকায় পড়তা হ্যায়। ‘এ ছালা বানচোদ তোম সংগ্রাম করতা হ্যায়’। তোমারা গভর্নর হ্যায় ত হ্যামারা কিয়া হ্যায়। এভাবে কিছুসময় কথা চলতে থাকলো। এরমধ্যে গাড়ি আলীপুর দীঘিতে পৌঁছানো মাত্র অপর প্রান্ত অর্থাৎ সাতক্ষীরা থেকে আগত ক্যাপ্টেন এর গাড়ীও আলীপুরে দেখা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের গাড়ী থামিয়ে স্যালুট মারতে থাকে। ওদের মধ্যে কি কথা হলো জানিনা। তবে ওখানেই আমাদের গুলির অর্ডার হয়ে গেল। আমাকে প্রথমে গাড়ি থেকে নামানোর সময় মাথা থেকে জিন্নাহ ক্যাপ পড়ে গেলে পাক আর্মি নিজের গায়ে ঝাড়া মেরে আমার মাথায় পরিয়ে দিল। ওদেরকও নামানো হলো। দীঘির পূর্ব পাড়ের মাঝখানে আমাদেরকে নেয়া হলো। আমার হাত খোলা তাই বোধ হয় আমাকে চাচা ও ভায়ের সামনে গুলি করার টার্গেট করলো। একজন মিলেশিয়া বিহারি আমার ডান হাত ধরলো অপরজন পাক আর্মি লান্সনায়েক আব্দুস ছালাম (যথাসম্ভব) এর চাইনিজ রাইফেলের নল বাম হাত দিয়ে ধরে অনুনয় বিনয় করতে থাকলাম। মাথা নাড়িয়ে না করে। বেশ কিছুক্ষন এভাবে সময় পার করার পর চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আলীপুর গ্রামের অনেকেই আমাদের এ দৃশ্য দেখছে। আমি আর দেরি না করে রাইফেল ছেড়ে দিলাম। তখন মা, আব্বা ও ভাই বোনদের কথা ভিষন মনে হচ্ছিল। এ সময় অল্প অল্প বৃ্ষ্টি হচ্ছিলো। সে সময় বাতাসের গতিও ছিলো। যাহোক রাইফেল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পেট বরাবর গুলি করা হয় যা আমার দেহে না লেগে দক্ষিনের বাতাসে উড়ন্ত জামার এ ফোড় ও ফোড় হয়ে যায়। কিছুটা অচেতন অবস্থায় গুলি করার পর পরই পানিতে পড়ে যায়।

এমন সময় পানির মধ্যে আরও দুইটি গুলির শব্দ শুনলাম। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এলে চুপিচুপি করে পানির মধ্যে জায়গা পরিবর্তন করলাম। পুকুরের মধ্যে বড়বড় কচুরিপানা থাকায় নাক উঁচু করে একটু শ্বাস নিয়ে আবার পানির মধ্যে ডুব দিলাম। ইতিমর্ধে পানির মধ্যে পাকিস্তান আর্মিও গাড়ি চলে যাবার শব্দ বুঝতে পেরেও খানিক্ষন দেরি করে পানি থেকে উঠে গুলিবিদ্ধ শহিদ চাচা ও টুকু ভায়ের ওখানে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসি এসে ওদের হাতে বাঁধা দড়ি খুলে দিল। আমাদের সবার পেট বরাবর গুলি করে ছিল। শহীদ চাচা চোখের সামনে মারা গেলো আর টুকু ভাই পেটে দুই হাত ধরে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো আর আমাকে বললো তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যা, সবাইকে খবর দে। টুকুভাইকে সাতক্ষীরা হাসপাতালে নেয়ার পর আবার তাকে পাক আর্মিরা মেরে ফেলে বলে জানা যায়। তখন রাস্তা পার হওয়ার সাহসও আমার ছিলোনা। নাম না জানা এক গ্রামবাসি আমাকে রাস্তা পার হওয়ার সাহস যুগিয়েছিলো। যখন বালিয়াডাংগা গ্রামের টিওরপাড়ায় পৌছাই তখন প্ষ্পুকাটি রইছউদ্দীন চাচার ভাইয়েদের সাথে কথা হয় (ওদের ভগ্নিপতিকে) কবর দিয়ে ওইপথে বাড়ি ফিরছিলো।

এখানে উল্লেখ্য যে, গফফার সরদার ১ জুলাই মোহাম্মদ আলী সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেয়েছিল। পরের দিন ২ জুলাই ১৯৭১ সাল। প্রথম মোহাম্মদ আলী সাহেবকে গুলি করে আমাদের গ্রামে এসে একইভাবে হত্যাকান্ড চালায়। এইভাবে আরো দুইটি তরতাজা জীবন আমাদের থেকে কেড়ে নেয়। আর এভাবেই অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই, আর আমার নুতন জন্ম হয়। আল্লাহ আমাকে আজও অনেক বাঁধা বিপদের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছেন। শুকরিয়া জানাই আল্লাহর কাছে। তাই প্রতি বছর ২ জুলাই উপলক্ষে সামান্য মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করে থাকি। এবারও অনেক বড় করে মিলাদ দেয়ার ইচ্ছা ছিলো। কারণ ৫০টা বছর পার করে সেই একই ক্যালেন্ডার ২০২১ সালে। কিন্তু পারলামনা নানান সীমাবদ্ধতার কারণে।

 

 

লেখক
নীলটু নূরুল রইছ
২০২২ ফার্মহাউজ ওয়ে
অ্যালেন, টেক্সাস-৭৫০১৩
যুক্তরাষ্ট্র