রোহিঙ্গা সঙ্কটের ৭ মাস, বহুমুখী সমস্যায় কক্সবাজার

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সঙ্কটের ৭ মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ রোববার (২৫ মার্চ)। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের ১২টি পয়েন্ট দিয়ে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। তারা আশ্রয় নেয় জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ১৬টি আশ্রয় শিবিরে। সরকারি হিসাবমতে, এ পর্যন্ত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়েছে। আরো কিছুসংখ্যক বাকি থাকতে পারে। সে হিসাবে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয় কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প।

আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে মাঝেমধ্যে বেশ তোড়জোড় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি এখন পর্যন্ত। শুধু চুক্তি আর চিঠি আদান-প্রদানেই রয়ে গেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। স্থানীয়দের দাবি, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার চাপ সামলাতে ইতোমধ্যে কক্সবাজারের সামাজিক, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয় ঘটেছে। খুব দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় কক্সবাজারের জন্য আরো বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলে মনে করে সচেতন মহল। তাদের দাবি, দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

উখিয়া হলদিয়া পালং ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম বলেন, ১৯৮০ সালের দিকে যে রোহিঙ্গারা এসেছে, তারাই এখনো ফেরত যায়নি। কাগজে কলমে কিছু ফেরত গেলেও বাস্তবে অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে। এবারও আমার মনে হয় সহজে প্রত্যাবাসন হবে না।

টেকনাফ কৃষক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন রাজু বলেন, সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যে নির্দিষ্ট ক্যাম্প করে দিয়েছে, সেখানে সঙ্কুলান না হওয়ায় শত শত রোহিঙ্গা দল বেঁধে রাতের আঁধারে স্থানীয়দের ফসলি জমি এবং পাহাড়ি বন দখল করে জোরপূর্বক ঘর নির্মাণ করছে। স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে বিচার দিলে বিচার পাচ্ছে না। এ ছাড়া প্রশাসন চেষ্টা করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, আমার প্রথম থেকে দেখছি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার মিয়ানমারকে ফেরত নেওয়ার জন্য তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। মিয়ানমারও ১৫ জানুয়ারিসহ কয়েক দফা সময় দিয়েছিল কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং এখন দেখছি প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, রোহিঙ্গা আসার ফলে অনেক স্থানীয় মানুষ বা ছেলেমেয়েরা চাকরি বা অন্যান্য কারণে কিছু আর্থিক সুবিধা পেলেও সেটা অস্থায়ী। বরং তারা যেভাবে আমাদের স্বাভাবিক জীবনের অর্থনৈতিক প্রবাহকে ঘুরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটার রেশ আমাদের দীর্ঘমেয়াদি টানতে হবে। রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের আঞ্চলিক অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেটা পোষাতে অনেক সময় লাগবে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মকর্তা আলী কবির জানান, ইতোমধ্যে ৬ হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প বিস্তৃত হয়েছে। সামনের দিনে কী হয়, জানি না। সবাই জানে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে পাহাড়, জঙ্গল সংরক্ষিত বনভূমি সবকিছুর বিশাল ক্ষতি হয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেটা ভালো, তবে সেটা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে কক্সবাজারের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যসহ আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর জন্য সমস্যা হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরফাজুল হক টুটুল বলেন, কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য এ পর্যন্ত ১৪৩টি মামলা হয়েছে তার মধ্যে ২০৬ জন রোহিঙ্গা আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১০টি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা মাদক, চোরাচালান, ধর্ষণ, পাচার, পতিতাবৃত্তিসহ নানা অপরাধে জড়িত আছে। তবে সবাই এক নয়। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ৫টি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ১টি স্থায়ী এবং টেকনাফে একটি পুলিশ ক্যাম্পসহ মোট ৭টি বিশেষ পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে, সেখানে থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার কারণে পৃথিবীর সব দেশের কাছে আমাদের সম্মান বেড়েছে। তবে এটা ঠিক যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার কারণে আমাদের বিশেষ করে কক্সবাজারের জন্য বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে সরকার এবং এনজিওগুলোও ইতোমধ্যে স্থানীয়দের জন্য বিশেষ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। এ সময় তিনি বলেন, আমি আন্তরিকভাবে চাইছি রোহিঙ্গারা দ্রুত তাদের নিজ দেশে ফেরত যাক।