খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের ভবন ধসের ঘটনায়

উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা! ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে পরিষদের এনেক্স ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের সময় ভবনের নির্মাণাধীন ‘সেন্টারিংয়ের ত্রুটির কারণে জেলা পরিষদের ভবন ধসের মূল কারণ’ বলে ঘটনাস্থলে একাধিক উদ্ধার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

পার্বত্য জেলা পরিষদের সম্প্রসারিত ভবনের কেন্ডিলিবারের ছাদ ধসে হতাহতের ঘটনায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। মর্মান্তিক প্রাণহানির এই ঘটনার পর ঠিকাদার লাপাত্তা রয়েছে। শনিবার(৮ই অক্টোবর) রাত সাড়ে ১১টায় উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী খাগড়াছড়ি সদর সেনা জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর রিয়াদুল ইসলাম এ উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

এর আগে উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর জোনে মেজর মো: রিয়াদুল ইসলাম জানান, আরো কয়েক জন শ্রমিক নিখোঁজ থাকার সন্দেহতিত সবাইকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রেখেছিল। এই উদ্ধার অভিযান চলে শনিবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত।

এ দিকে শ্রমিক হতাহতের অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণ উদঘাটন ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের শনিবার রাতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রুফ চৌধুরী অপু তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য কল্যাণ মিত্র বড়ুয়াকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে সাত কার্যদিবসে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, খাগড়াছড়ি গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও খাগড়াছড়ি এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী।
ছাদ ধসের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস। পার্বত্য জেলা পরিষদের সম্প্রসারিত ভবনের কেন্ডিলিবারের ছাদ ধসে নিহত দুই শ্রমিকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা ও আহতদের সু-চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও এঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংস্ইপ্রফু চৌধুরী অপু।
রোববার(৯ই অক্টোবর) সকালে তিনি এই প্রতিবেদককে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

ঘটনার বিবরনে জানা যায়, শনিবার(৮ই অক্টোবর) বিকেল ৪টার দিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্মাণাধীন অবস্থায় সম্প্রসারিত ভবনের কেন্ডিলিবারের ছাদ ধসে দুই নির্মাণ শ্রমিক নিহত ও আরো ৫জন আহত হন। নিখোঁজ আরো অন্তত: ৩জন বলে জানা গেছে। ২জন শ্রমিকের মৃত্যু পর এতে ৯জন শ্রমিক আহত হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো কয়েকজন। এ ঘটনায় ছাদের নিচে আটকা পড়েছে সন্দেহতিত আরো কয়েকজন। তাদের উদ্ধারে কাজ করেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। নিহতের এক জনের নাম সাজ্জাদ হোসেন(২২) বলে জানা গেছে। সন্ধ্যায় ঢালাইয়ের নিচে চাপা অবস্থায় আরো একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সে বাগেরহাট জেলার শিবপুর ইউনিয়নের সোহরাব হোসেনের ছেলে মো: সাইফুল ইসলাম সিকদার(২৮)। ধসে পরা ছাদের নিচে নিখোঁজ শ্রমিকদের উদ্ধারে তাৎক্ষনিক নেমেছিল ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্মাণাধীন সম্প্রসারিত ভবনের কেন্ডিলিবারের ছাদ ঢালাই চলাকালীন হঠাৎ ধসে পড়ে। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহত ৯জনকে উদ্ধার করে জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে পাঠালে মো: সাজ্জাদ হোসেন(২২) নামে একজন মারা যান। নিহত সাজ্জাদ হোসেন খাগড়াছড়ি পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডে কলেজ গেট এলাকার মো: আমিনের ছেলে বলে জানা গেছে। তিনি ছাত্র ও শ্রমিক হিসেবে থাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে’র এইচএসসি(একাদশ) ভোকেশনাল জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্্র বিভাগের ২য় বর্ষে ছাত্র। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে আরো এক জনের লাশ উদ্ধার হয়।

আহতরা হলেন, শালবাগানের মুসলিম উদ্দিনের ছেলে মো: সোহেল(২৩), আবুল সামাদ ছেলে মো: রোকন(২৪), আব্দুল ছালামের ছেলে মো: হানিফÑ১(২৫), মাইসছড়ির লালূচাদ ছেলে মো: হাসান(২৪), মাটরাংগা’র আব্দুল খালেকের ছেলে মো: হানিফÑ২(২৭)।

অভিযোগ রয়েছে, শনিবার বন্ধের দিন হওয়ায় ছাদ ঢালাইয়ের সময় ঘটনাস্থলে কোন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না। ঢালাইয়ে লোহার খুটির পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে ঠেস দেওয়া হয়েছিল। সেন্টারিং সিস্টেম ছিল ক্রটিপূর্ণ। ঘটনার পর জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমার নাম্বারে একাধিক বার কল দিলেও নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সহকারী প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার হাওলাদার এবং জিকু চাকমার মোবাইলে কল দিলে তাদের নাম্বারও বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনা এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও জেলা পরিষদের কোন কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে ও হাসপাতলে দেখা যায়নি। এমন কি কোন কর্মকর্তাকে ফোনেও পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, নতুন ভবনের গ্রিল শেড নির্মাণের ধালাইয়ের কাজ চলাকালে হঠাৎ করে ছাদের উপরের অংশ ধসে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস স্থানীয়দের সাথে নিয়ে ৬জনসহ পরে ৯জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ঘটনায় হঠাৎ ধসে পড়ে ছাদ। আটকা পড়ে অনেক শ্রমিকরা। তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৯জন শ্রমিককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সাজ্জাদ হোসেন নামে এক শ্রমিক মারা যায়।

নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, হঠাৎ বিকট শব্দে নির্মাণাধীন ভবনের একাংশ ধসে পড়ে। ধসে পড়া ভবনের নিচে কাজ করা শ্রমিকরা আটকা পড়েন। এসময় উদ্ধার করা ৯জন শ্রমিককে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরও পাঁচ শ্রমিকসহ ৯জন। ওই ভবনের নিচে আরও তিন শ্রমিক আটকা পড়ে আছেন, এমন শঙ্কা থেকে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও খাগড়াছড়ি সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছাদের নিচ থেকে আরো এক জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মো: আরিফ হোসেন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ধসে পড়া ছাদের নিচে আরো শ্রমিক আটকে রয়েছে।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ছুটে যান সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তি চাকমা, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রফু চৌধুরী অপু, জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, পৌর মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিনিয়া চাকমা, পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো: শানে আলম প্রমুখসহ জনপ্রতিনিধি।

খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার রাজেশ বড়ুয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ছাদটি নির্মাণের যে সেন্টারিং তৈরি করা হয়েছে সেটি দুর্বল ছিল। ঢালাই কাজ চলাকালীন বাঁশে সেন্টারিংটি ভার নিতে নিতে পারেনি। তাই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনায় আর কোনো শ্রমিক ছাদের নিচে চাপা পড়ে আছেন কিনা সেজন্য উদ্ধার কাজ চলছে।

খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মো: আরিফুর রহমান জানান, ঘটনায় এখনো পর্যন্ত থানায় অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। আসলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পুলিশ একটি জিডি করে রেখেছে। পরিষদের সম্প্রসারিত ভবনের সামনের অংশের ছাদ ঢালাইয়ে ১৬জন শ্রমিক কাজ করছিলেন। নিহত ২শ্রমিকের মরদেহ আধুনিক জেলা সদর হাসাপাতালে রয়েছে। উদ্ধার হওয়া বাকি সদস্যদের হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

খাগড়াছড়ি সেনাবাহিনীর সদর জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর রিয়াদুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস মিলে আমরা নিখোঁজ শ্রমিকদের উদ্ধারে কাজ করেছি। আমরা প্রাথমিকভাবে দেখছি ছাদের সেন্টারিংয়ের ত্রুটির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা চেষ্টা করছি, যতদ্রুুত সম্ভব উদ্ধার কাজ চালিয়ে গিয়ে এ উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
খাগড়াছড়ি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিনিয়া চাকমা জানান, ঘটনাটি শুনার সাথে সাথে প্রত্যক্ষ সরেজজমিনে উদ্ধার কাজে অব্যাহত রেখেছে এবং এলাকাটিকে পুলিশ ঘিরে নিরাপত্তা বলয় অব্যাহত রেখেছি। হাসপাতাল এলাকায়ও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রæু চৌধুরী অপু বলেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে সংঘটিত ঘটনাকে দুঃখজনক আখ্যায়িত করে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ নিহত দুই শ্রমিকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা, আহতদের সু-চিকিৎসা ও ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্মান ঠিকাদার ও প্রকৌশলী ব্যক্তিত্ব যে হোক সঠিক প্রমান পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করবে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখছি। এখন আর শ্রমিক আটকে আছে কিনা তা আমরা প্রত্যক্ষ সরেজমিনে উদ্ধারে কাজে দেখছি। ’ তিনি নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন জানান।

এদিকে নির্মাণ কাজের ঠিকাদারকে এবং প্রকল্পের ব্যয় কত টাকা এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কেউই মুখ খুলছে না।

উল্লেখ্য, গত শনিবার(৮ই অক্টোবর) বিকাল ৪টায় পার্বত্য জেলা পরিষদের নতুন ভবনের সম্মুখভাগে ছাদ ভেঙ্গে পড়ে ২জন নির্মাণ শ্রমিক নিহত ও ৯জন শ্রমিক আহত হয়। নির্মানধীন চলমান অবস্থায় জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ চত্বরে সম্প্রসারিত ছাদের ধালাই চলাকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পার্বত্য জেলা পরিষদের নতুন ভবনের ছাদ ঢালাই কাজের সময় ভবনের একাংশ ধসে পড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ভবনে আরো কয়েকজন নির্মান শ্রমিক আটকা আছে। পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্মানাধীন ভবন ধসের পর চলছে উদ্ধার অভিযান। এর পর সমাপত ঘোষনা।

ঘটনার সময় বিকাল ৪টায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সম্প্রসারিত ভবনের সামনের অংশের ছাদ ধালাইয়ে ১৬জন শ্রমিক কাজ করছিলেন। ২০১৮সালের দিকে পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ভবনটার সামনের অংশে ১৬জন শ্রমিক কাজ করছিলেন বলে জানা গেছে। অর্থাৎ নির্মাণাধীণ ভবেন ১৬জন শ্রমিক কাজ করছিলো।