কর্মহীন জীবনে লাগামহীন দ্রব্য মূল্য আত্রাইয়ে হরিজনদের যেন কষ্টের শেষ নেই

নওগাঁর আত্রাই উপজেলায় বসবাসরত হরিজনরা রয়েছেন নানান কষ্টে। ব্যবসা-বানিজ্য ,কৃষি আবাদ কিম্বা নেই কোন কর্ম। এরই সাথে লাগামহীন দ্রব্য মূল্যে স্ত্রী-সন্তান তথা পরিবার পরিজন নিয়ে পরেছেন চরম বিপাকে। টাকার অভাবে অনেক শিশুরা বাদ দিয়েছেন পড়ালেখা। ধর্মীয় শিক্ষার নেই কোন ব্যবস্থা।

তবে আছেন কেমন,এমনটা জানতে খোঁজও রাখেননা কেউ বলে জানিয়েছেন হরিজনরা। তাদের মতে,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বা হাটে বাজারে তারা যে পেশায় কর্ম করে জীবন যাপন করতেন এখন সেই পেশা দখল করে নিয়েছেন অন্য ধর্মের লোকজন। ফলে তারা কর্মহীন হয়ে পরেছেন।

উপজেলার পতিসরে সরেজমিন গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানাযায়,বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারী বাড়ী চত্বরেই হরিজন সম্প্রদায়ের ৯টি পরিবার বসবাস করেন। এসব পরিবারে মোট ৫০জনের মতো সদস্য রয়েছেন। কবি গুরুর আগমনের সময় তাদের পূর্ব পুরুষরা এখানে এসেছিলেন।

সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের মাথা গোঁজার মতো সামান্য জায়গা দিয়ে গেছেন। ওই সময় থেকেই বিভিন্ন হাট-ঘাটে এবং প্রতিষ্ঠানে সুইপার হিসেবে কাজ করে জীবন যাপন করে আসছেন তারা। ভারতি বাশফোঁর জানান, আমাদের কোন জায়গা জমি নেই, কোন আবাদ-বুনাদ করতে পারিনা। আমরা কোন দোকান দিয়ে যে ব্যবসা করবো তাও পারিনা। কারন আমরা সুইপার বলে আমাদের দোকান থেকে কেউ কিছু কিনবেনা, আমাদের হাতের কেউ কিছু খাবে না। গ্রামে কারো বাড়ীতে শ্রমীক হিসেবে যে কাজ করবো কেউ তো আমাদেরকে কাজে নেয়না। কিভাবে রোজগার করবো, কি খাবো,সন্তানদের মূখে কি তুলে দিবো তা নিয়ে চরম ঘোরপাকে পরেছি।

একমাত্র পানি ছাড়া সবই কিনে খেতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত যেভাবে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে তাতে আমাদের নি:স্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অর্থভাবে মেরামত করতে পারিনি ভাঙ্গা টিনের চালা। ফলে বৃষ্টি-বাদলে সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে দিন-রাত পারি দিতে হচ্ছে। তিনি জানান, সংসারে স্বামী, তিন মেয়ে এক ছেলে রয়েছেন। গত বছর মেয়ে জয়া বাশফোঁর এসএসসি পরীক্ষা দিতো। কিন্তু টাকা অভাবে ফরম ফিলাপ করতে পারেনি। তাই পরীক্ষা দেয়া হয়নি।

কিছু দিন আগে মেয়েটা গ্রামে কাপড় শেলাইয়ের ট্রেনিং নিয়েছে। কিন্তু টাকার যোগার না হওয়ায় শেলাই মেশিন কিনতে পারছেন না। ফলে মেয়েটাও বেকার বসে আছে। তিনি জানান, স্বামী ভানু বাশফোঁর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে শুধুমাত্র সৌচাগার পরিষ্কারের কাজ করেন। কিন্তু প্রতি দিনতো আর কাজ হয়না। ওই কাজে যে টাকা পায় তা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করতে হচ্ছে।

বিধবা পারবতি বাশফোঁর বলেন, কালীগঞ্জ বাজারে একটি সৌচাগার পাহাড়া দিয়ে প্রতিদিন দেড় দুইশ‘টাকা পেয়ে থাকেন। সেখানে যাওয়া আসা করতেই প্রায় ৫০/৬০টাকা খরচা হয়ে যায়। যা থাকে তা দিয়ে চাল কিনলে তেল হয়না, মরিচ কিনলে কাঁচা বাজার হয়না। আমরা তাহলে কিভাবে বেঁচে আছি বাবু বলুন! প্রতিদিনই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দর বারছে,কিন্তু আমাদেরতো আর কামায় বারছেনা।

বিধবা শেফালী বাশফোঁর জানান,তার শিশু সন্তান অরগো বাশফোঁর ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পরে। টাকা অভাবে প্রাইভেট পড়াতে পারছেননা। সরকার থেকে উপ-বৃত্তির যে টুকু টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে খাতা কলম কিনে দেই। তিনি বলেন,প্রতি বছর পতিসরে কবি গুরুর জন্মো’সব আসলে আমরা কাচারী বাড়ী ঝাড়-ঝাটা দিয়ে সরকার থেকে ১০/১২ হাজার টাকা করে পেতাম।

ওই টাকা দিয়ে সবাই মিলে সন্তান-আত্মীয়দের নিয়ে আনন্দ ভোগ করতাম। কিন্তু গত ৪/৫ বছর ধরে কর্মসূচীর লোক দিয়ে কাজ করে নেয়ায় আমাদের কামায়ের সে পথটাও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন,বসবাসের জায়গা অল্প হওয়ায় কুটুম আসলে এক ঘরেই সবাই মিলে থাকতে হয়।

আত্রাই উপজেলা হরিজন এসোসিয়েশনের সভাপতি জাতআমরুল গ্রামের শুধির বাশফোঁর বলেন, আমরা যে কর্ম করে জীবন যাপন করতাম তা এখন অন্য ধর্মের লোকজন দখল করে নিয়েছে। ফলে আমরা পরেছি বেকায়দায়। আমরা কিভাবে বেঁচে আছি, কেউ খোঁজ নেয়না। প্রতি মাসে মাত্র ৫০০টাকা করে হরিজন ভাতা দেয়া হয়। তাও আবার প্রতি তিনমাস পরপর। কিন্তু এই ভাতা সবাই পায়না। ধর্মীয় শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে আমাদের সন্তানরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।আমাদের দুরবস্থা দেখার কেউ নেই। এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে তিনি সরকারের কাছে সার্বিক সহযোগিতার কামনা করেছেন।

আত্রাই উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, উপজেলায় কতজন হরিজন আছে তা বলতে পারছিনা। তবে হরিজন নামে মোট ৪২২জন ভাতা পেয়ে থাকেন।

আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্চিতা বিশ্বাস বলেন, এই উপজেলায় হরিজন সম্পর্কে এখনো ভাল জানা হয়নি। তাদের বিষয়ে সার্বিক খোঁজ খবর নিয়ে সহায়তা করা হবে।