পাকা ফসল হারিয়ে কাঁদছেন কৃষক

কদিন আগেই বরেন্দ্র অঞ্চলে শুরু হয়েছে আমন কাটা-মাড়াই। ভালো ফলন পেয়ে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠছিলো চাষিদের চোখে-মুখে। কিন্তু গত কয়েকদিন ভারী বৃষ্টি এবং কালবৈশাখীতে তা ম্লান হয়ে যায়।

বিলগুলো জলমগ্ন হয়ে পড়ায় তলিয়ে যেতে শুরু করেছে ধান। সেইসঙ্গে শ্রমিক সংকট চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়েছে কৃষকদের কপালে। ফলে শেষ মুহূর্তে ফসল ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় চাষিরা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৬৬ হাজার ২১২ হেক্টর। লক্ষমাত্রার চেয়ে তিন হাজার হেক্টর বেশি জমিতে চাষ হয়েছে ধান।

এবার চার লাখ ১১ হাজার ৭৭ মেট্রিক টন ধান এবং তা থেকে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৫১ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরে কৃষি দপ্তর। তবে শেষ মুহূর্তের দুর্যোগে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কায় কৃষি দপ্তর।

কৃষকরা বলছেন, এবার প্রথম থেকেই আবহাওয়া অনেকটাই অনুকূলে ছিলো। ফলনও ভালো প্রত্যাশা করছিলেন চাষিরা। তবে ধানের শীষ বের হওয়ার সময় দুই দফা শিলা বৃষ্টির কবলে পড়ে বোরো ধান।

কোথাও কোথাও দেখা দেয় ব্লাস্ট রোগ। ক্ষতি কাটিয়ে সেই ফসল ঘরে তুলতে শুরু করেছেন চাষিরা। কিন্তু গত কয়েকদিন তুমুল কালবৈশাখীতে নুয়ে পড়ে ধান। সঙ্গে ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ধানখেত। শ্রমিক না পাওয়ায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন ফসলের আশা। এতে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে বিপাকে পড়েছেন ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টির পানিতে জেলার তানোর উপজেলার শিবনদী ও বিলকুমারী বিলের পানি বেড়ে কয়েকশো হেক্টর বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। তানোরের শিবনদী সংলগ্ন চৌবাড়িয়া, কামারগাঁ, তালন্দ, চাপড়া, গোকুল, শিতলীপাড়া, কুঠিপাড়া, আমশো, বুরুজ, কালীগঞ্জ ও চাঁন্দুড়িয়া এলাকার অনেক ধানখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শিবনদী বিলের ধানের জমি পানির নিচে। শ্রমিক সংকটের কারণে বিলের উঁচু এলাকার জমির ধান কাটতে পারছেন না কৃষকরা। আর পানিতে তলিয়ে যাওয়া পাকা ধান কচুরিপানায় ঘিরে ফেলেছে। কোনো কোনো কৃষককে কোমর পানিতে নেমে ধান কাটতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ নৌকাযোগে ধান কেটে বাঁধে নিয়ে এসে মাড়াই করছেন। আবার যেসব কৃষকের ধান পুরোপুরি তলিয়ে গেছে তারা ফসলের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। সোনার ফসল হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা। অনেক কৃষক হতাশায় কাঁদছেন।

স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডিএফএম এমদাদুল ইসলাম বলেন, পানিতে বোরো ধান তলিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কৃষকরা সেসব ধান কাটার চেষ্টা করছেন। বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৮ মণ ফলন হচ্ছে। তবে পানি না থাকলে ২০ থেকে ২২ মণ ফলন হতো।

বিলকুমারী বিলে দুই বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেন তানোর পৌরশহরের চাপড়া এলাকার কৃষক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, খেতে পেকে উঠেছিলো ধান। পরিকল্পনাও নিচ্ছিলেন ফসল ঘরে তোলার। কিন্তু ভারী বৃষ্টিতে হঠাৎ করে বিলে পানি বেড়ে যাওয়ায় এক রাতেই তলিয়ে গেছে তার পুরো ধানখেত।

একই দশা গোকুল গ্রামের কৃষক গোলাম রাব্বানীর। ভূমিহীন এই কৃষক অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করেছিলেন। পুঁজি না থাকায় এনজিও থেকে নিয়েছিলেন ঋণ। প্রতিবছরই এভাবে ধান চাষ করেন তিনি। পেটের খাবার যোগান দেয়ার পর উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু এবার তার সে আশায় গুঁড়েবালি। ঘরে ফসল তোলা তো দূরের কথা, উল্টো মাথায় ঋণের বোঝা চাপলো তার।

উপজেলার ধানতৈড় গ্রামের কৃষক সাফিউল ইসলাম জানান, গত বছর ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করেন তিনি। প্রতিবিঘা জমিতে ২৩ থেকে ২৮ মণ (২৮ কেজিতে কাচির মণ) ধান হয়েছিলো। কিন্তু এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এবং অসময়ে ধান কাটার কারণে ফলন অর্ধেকেও পাওয়া যাবে না।

তানোর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম মোল্লা জানান, ইতোমধ্যে রাতের আঁধারেই বিলকুমারী বিলের বেশ কিছু জমির বোরো আবাদ পানির নিচে চলে যাওয়ায় ধান গাছে পচন ধরতে শুরু করেছে। পানি বাড়তে থাকায় কৃষকরা এই ধান আর ঘরে তুলতে পারবেন বলে মনে হয় না। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

জেলার পবা, গোদাগাড়ী, মোহনপুর, বাগমারা ও দুর্গাপুরসহ অন্য উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই বছর ধরে তারা অসময়ের ভারি বৃষ্টিতে বিল জলমগ্ন হয়ে পড়ায় ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না। টানা ফসলহারা নিঃস্ব কৃষক বুকভরা আশা নিয়েই এবার বোরো চাষে নেমেছিলেন।

তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, গত সোমবার শিলাবৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিবনদীতে বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে। সেসব জমির ধান ভিজে যাওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা আগামীতে স্বল্পমেয়াদী জাতের ধান আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করবো। কৃষকরা এতে সাড়া দিলে তারা আগাম ধান কেটে ঘরে তুলতে পারবেন।

তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার বোরো চাষিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি।

এ প্রসঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালি বলেন, শুধু রাজশাহী জেলা নয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জেও বৃষ্টি হয়েছে। এতে ফলন পাঁচ থেকে ১০ ভাগ কমতে পারে। তবে এতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো ঘাটতি থাকবে না। কৃষকদের দ্রুত ধান কেটে নেয়ার পরামর্শ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।