উদ্বোধনের অপেক্ষা: স্বপ্নের দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু বাস্তবে

বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের দীর্ঘদিনের দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু নিয়ে প্রত্যাশিত স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। প্রায় একশ’ ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত এই সেতুটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

সেতুর প্রায় ৯৮ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ায় তিস্তা নদীর পশ্চিমপাড়ের রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার মানুষ এখন আনন্দে উদ্বেলিত। আগামী জুনে বাকি কাজ শেষ হলে যানবাহন চলাচলের জন্য যেকোনো সময় উন্মুক্ত করে দেয়া হবে সেতুটি। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে মহিপুর এলাকায় তিস্তা নদীর উপর নির্মিত এই সেতুটির উদ্বোধন হলে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর বুড়িমারীসহ লালমনিরহাটের চারটি উপজেলার সাথে সারাদেশের দূরত্ব কমে আসবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার।

লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়। এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে পাথর, ফল, কয়লা, কাঁচসহ আরও অনেক পণ্য আমদানি হয়ে আসে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় জুস, বিস্কুটসহ কিছু ভোগ্যপণ্য। এ ছাড়া ভারতের দার্জিলিংসহ আরও কিছু দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার জন্য বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে যেতে হয়। সেতুটি উদ্বোধন হলে রংপুর থেকে সড়কপথে বুড়িমারী ৫০ কিলোমিটার পথ কমবে। এতে একদিকে চলাচলে যেমন সময় কমে আসবে, তেমনি কমবে যাতায়াত খরচ আর প্রসার ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যের।

লালমনিরহাট স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তিস্তা নদীর উপর গঙ্গাচড়া-কালীগঞ্জ সড়ক সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরে গ্রামীণ যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে এটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়।

৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য মূল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩১ কোটি টাকা। এটি নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে ‘ডাব্লিউ এমসিজি-নাভানা গ্রুপ। এছাড়া কালীগঞ্জের কাকিনা হতে গঙ্গাচড়ার মহিপুর ঘাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সংযোগ সড়কের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। সংযোগ সড়কে তিনটি কালভার্ট ও দুটি ছোট সেতুর নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। মূল সেতু ও পুরো সড়ক জুড়ে থাকবে আলোর ব্যবস্থা।

সূত্রটি আরো জানায়, এ অঞ্চলের মানুষ তিস্তা নদীর উপর (কালীগঞ্জ-গঙ্গাচড়া) একটি সড়ক সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছিল। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। সেতু নির্মাণে ২২ মাস সময় ধরা হলেও ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রথম দফার মেয়াদ শেষে সেতুর ৪৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় কাজের মেয়াদ ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট ২২ মাসের পর অতিরিক্ত এক বছর সময় বৃদ্ধি করা হলে ওই সময় পর্যন্ত সেতুর ৬৫ ভাগ কাজ শেষ হয়। তৃতীয় দফায় ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফের মেয়াদ বাড়ানো হলেও এই সময়ের মধ্যে মূল সেতুর শতভাগ কাজ শেষ হয়নি। তাই আবারও সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু আরো ২ মাস সময় চেয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। আশা করা হচ্ছে আগামী জুন মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে সেতুর বাকি ২ শতাংশ কাজ। এদিকে লালমনিরহাট-বুড়িমারী আঞ্চলিক মহাসড়কের সঙ্গে সেতুর সংযোগের জন্য পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় পাঁচ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক, তিনটি কালভার্ট ও ছোট দুটি সেতুর নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর এবং ৯ দশমিক ৬০ মিটার প্রস্থের এ সড়ক সেতুর দু’পাশে রেলিংসহ ২ দশমিক ৩০ মিটার প্রস্থের ফুটপাত রয়েছে। সেতুটির উত্তর পাশে (কাকিনার দিকে) তিস্তা নদীর বাঁ তীরে এক হাজার ৩০০ মিটার দীর্ঘ নদী শাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাকা করা হয়েছে। অপরদিকে সেতুটির দক্ষিণ দিকে (মহিপুর অংশে) পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুরোনো নদী শাসন কার্যক্রমের সিসি ব্লক রয়েছে।

এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু চলাচলের জন্য উদ্বোধন করে দিলে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার মধ্যে চারটি যথাক্রমে আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার মানুষ যেকোনো সময় রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর রংপুরসহ যেকোনো স্থানে যাতায়াত করতে পারবে। এতে তাদের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলার এলজিইডি প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান বলেন, সেতুটির মূল অবকাঠামোর ৯৮ ভাগ নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। সেতুটিতে লাইটপোস্ট স্থাপনসহ টুকিটাকি কাজ বাকি আছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, সেতুটির উজানে নদীর মাঝামাঝি বালুর যে নতুন চর দেখা দিয়েছে, তা অপসারণ করা হলে সেতুটির সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। কারণ, এই চর থাকলে নদীর স্বভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে দুই পাড়ে আঘাত করলে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।