তিন পার্বত্য জেলায় ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব পারিবারিক আয়োজনে

খাগড়াছড়ি রাংগামাটি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ফের এ বছরও মহামারি কোভিড করোনা ভাইরাস প্রকট আকার ধারনের কারণে গত বছরের ন্যায় এবারও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রাণের সামাজিক উৎসব ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি জাক-জমক না হওয়ার আশংকা করেছেন নীতি নির্ধারকরা।

নানা তথ্যে জানা যায় ইতিমধ্যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনগুলো উৎসব না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য বিধি মেনে পারিবারিকভাবে পালন করা হবে দিনটি। গেল বছরও একই কারণে পাহাড়ে বৈসাবী উৎসবের আয়োজন ছিল না। অতীতের বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি পাহাড়ে ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসাবি’ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ে পাহাড়ি-বাঙালির মিলন মেলায় পরিণত হতো।

প্রতি বছর খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার বটতলী নামক এলাকায় বসে মারমা জনগোষ্ঠী সাংগ্রাই উৎসবের সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিকতার মাসব্যাপী আয়োজন। মারমা উন্নয়ন সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত উৎসবে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, র‍্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পানি খেলাসহ আরও নানা আয়োজন। উৎসবটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসত। এবারও সেখানে থাকছে না উৎসবের কোনো আনুষ্ঠানিকতা।

প্রতি বছর ১২ই এপ্রিল নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে মূল উৎসব শুরু হয় পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছর বরণকে সামনে রেখে গ্রামে-গ্রামে চলে নানা আয়োজন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহবাহী নানা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অতিথি আপ্যায়ন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে আনন্দ র‍্যালি, মারমাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টিবল বা পানি উৎসব ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের গড়িয়া নৃত্য’র আয়োজন করে থাকে।

মূলত প্রতিবছর ১২ই এপ্রিল চাকমা সম্প্রদায়ের ফুল বিজুর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে ‘বৈসাবি’ উৎসব শুরু হয়। সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন নামে উৎসবটি হয়ে থাকে। ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’। তিন সম্প্রদায়ের তিন নাম নামে আদ্যক্ষর দিয়েই নামকরণ হয় ‘বৈসাবি’। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি পাহাড়ে উদযাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসাবি’ উৎসব।

১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উসব পালন করে আসছে। যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব নামে ‘ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই এবং চাকমা ভাষায় বিজু’ নামে এ উৎসব পালন হয়ে থাকে। এ তিন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষার নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হয়।

ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও অবস্থানকে বৈচিত্রময় করে করে তুলতে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে। কিন্তুু মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছর থেকে উৎসব-আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে পাহাড় আর সমতলের মানুষ।
বৈসাবি উৎসবকে সামনে রেখে খাগড়াছড়ি জেলার হাট-বাজারে কেনা-কাটা বেড়ে যেতো।বিপনী বিতানগুলোতে এখন পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙ্গালী তরুনীদেরও উপচে পড়া ভীর লেগে থাকতো। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে খাগড়াছড়ির হোটেল-মোটেলগুলো আগাম বুকিং হয়ে যেতো। কিন্তুু এ বছর পুরো ভিন্ন চিত্র।

খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা জানান, সমিতির আওতায় জেলায় মোট ২৬টি হোটেল রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পর হোটেলগুলোতে পর্যটকদের সব বুকিং বাতিল করা হয়েছে। অনেক হোটেল ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ত্রিপুুরা কল্যান সংসদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অনন্ত ত্রিপুরা জানান, করোনার এমন পরিস্থিতিতে উৎসব আয়োজনের কোন সুযোগ নেই। এবারও আমরা কোন আনুষ্ঠানিকতা রাখিনি। সকলকে ঘরে ঘরে ছোট পরিসরে দিনটি উদযাপনের জন্য বলেছি। এখন পরিবার পরিজন নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা জরুরী।

মারমা উন্নয়ন সংসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মংপ্রুু চৌধুরী বলেন, এই মুহুর্তে উৎসব পালনের চেয়ে নিজেরা রোগবালাই থেকে সতর্ক অবস্থান বজায় রেখে বেঁচে থাকাটা জরুরী। প্রশাসন থেকেও জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আগামীতে করোনার প্রকোপ কমে গেলে আমরা দ্বিগুণ আনন্দে উৎসব আয়োজন করবেন বলে আশাবাদী।
উলেখ্য মহামারি করোনা ভাইরাস গ্রাস করে নিয়েছে মানুষের দৈনদিন জীবনযাত্রা। প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। করেনা সংক্রমণ রোধে ইতোমধ্যে দেশে লকডাউনের ঘোষনা করেছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে এবারও পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসাবি’ উৎসব ঘিরে থাকছে না কোনো আনুষ্ঠানিকতা।

গেলো বছরও একই কারণে পাহাড়ে ‘বৈসাবি’ উৎসবের কোনো আয়োজন ছিলো না। ইতোমধ্যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনগুলো উৎসব না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘরে ঘরে পালন করা হবে দিনটি।

এর আগে জেলা প্রশাসন থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।