মঠবাড়িয়ায় ১০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অডিট : অর্ধ কোটি টাকা কর্মকর্তার পকেটে

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ধ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে অডিট কর্মকর্তা মোঃ শামীম আলীর বিরুদ্ধে। তিনি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক।

গত ২৮ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত মঠবাড়িয়া উপজেলার এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেন তিনি। পরিদর্শনের তালিকায় ছিল মহিউদ্দিন আহমেদ মহিলা ডিগ্রী কলেজ,খাস মহল (কে এম) লতিফ ইনস্টিটিউশন, নলী চরকগাছিয়া তমিজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়,মিরুখালী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এ্যান্ড কলেজ, আব্দুল হামিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়,রাজারহাট শহীদ বাচ্চু মাধ্যমিক বিদ্যালয়,সাপলেজা মডেল হাই স্কুল, সোনাখালী মুন্সী আব্দুল কাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়,মিঠাখালী পিজিএস আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং টিকিকাটা নূরিয়া ফাজিল মাদ্রাসা।

জানা গেছে,অডিট শুরু হওয়ার পূর্বেই শিক্ষক – কর্মচারীদের মধ্যে ঘুষ বানিজ্যের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।অডিটের ফলাফল পজিটিভ করতে অডিটরকে এক মাসের বেতন ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে তাদের। আর ঘুষের এ টাকা সহকারী শিক্ষকদের নিকট থেকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। বিল বন্ধ করে দেওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে চান না তারা।লিখিত অভিযোগ দেওয়ারও সাহস পান না তারা। তবে ঘুষ দেওয়ার আলোচনা সমালোচনা এখন অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানের বাইরেও।

মহিউদ্দিন আহমেদ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আজিম উল হক জানান, এ বছরের অডিট তালিকায় আমার প্রতিষ্ঠানও ছিল।কিন্তু অডিট কর্মকর্তাকে আমাদের কোন ঘুষ দিতে হয়নি।

খাস মহল (কে এম) লতিফ ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান জানান,১০টি প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে অডিট কর্মকর্তার কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হতো না।আমাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাই বাছাই সহ উন্নয়নমূলক কাজের ১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টিও তারা আমলে নিয়েছে।

নলী চরকগাছিয়া তমিজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, আমি কোন টাকা দেব না।যদি আমার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীকে হয়রানি করা হয় তাহলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ দেওয়া হবে।

মিরুখালী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, ঘুষের ব্যাপারে আমাদের কোন অভিযোগ নেই।সব প্রশ্নের উত্তর সব সময় দেওয়া যায় না।প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে অনেক সময় বাস্তবতা মেনে নিতে হয়।আমি নিজেও একজন সাংবাদিক এবং শিক্ষক নেতা।তারপরেও এ বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।

সাপলেজা মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাশেদ জানান,অডিট শুরুর আগের দিন অনুষ্ঠিত কর্মশালায় অডিটের ক্ষেত্রে বিকল্প কিছু চিন্তা না করার জন্য আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি।এ সময় অডিট কর্মকর্তার সাথে আমাদের কিছুটা বাক বিতন্ডাও হয়েছিল।আমার প্রতিষ্ঠান থেকে অডিট কর্মকর্তাকে কোন ঘুষ দেইনি।

টিকিকাটা নূরিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ আবু জাফর জানান,অডিট কর্মকর্তা যেভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন তাতে টাকা না দিয়ে উপায় নেই। যদিও ১০ বছরের মধ্যে একবার মিনিস্ট্রি অডিট হওয়ার কথা কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৭ বছর পরেই আবার অডিট।তবে যা হবার হয়েছে আমরা এ বিষয়ে কোন অভিযোগ দিতে চাই না।

রাজারহাট শহীদ বাচ্চু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহিরুল ইসলাম জানান,আমাদের বিদ্যালয়ে ২০১৫ সালে মিনিস্ট্রি অডিট হয়েছে।৭ বছর পর আবার এ বছর হয়েছে। তবে অডিট কর্মকর্তাকে কোন ঘুষ দিতে হয়নি।এছাড়া আমার প্রতিষ্ঠানে কোন অসঙ্গতিও পায়নি।

খাস মহল (কে এম) লতিফ ইনস্টিটিউশনের সহকারি শিক্ষক এনামুল হক জানান,আমি অডিট কর্মকর্তার থাকা খাওয়া সহ দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলাম।আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কোন টাকা নেয় নি। তবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সকল শিক্ষকদের এক এমপিও পরিমান টাকা নিয়েছে।

আব্দুল হামিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান জানান, আমাদের অসঙ্গতি ছিল সহকারি শিক্ষক নিয়োগে (কমিটির নিয়োগ) ডিজির প্রতিনিধি চেয়ে চিঠি।আর অন্যান্য কিছু অসঙ্গতিতো আছেই।তবে অডিট কর্মকর্তা আমার স্কুল থেকে কোন টাকা পয়সা চায়নি।শুনেছি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে চেয়েছে।

মিঠাখালী পিজিএস আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরেশ চন্দ্র বারিক জানান,আমাদের প্রতিষ্ঠানে ২৮ জুন অডিট হয়।সন্ধ্যায় অডিট শুরু হয়ে রাত ১০টার দিকে শেষ হয়। কিন্তু অডিট কর্মকর্তা আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কোন টাকা দাবি করেন নি এবং আমরাও কোন টাকা দেই নি।

সোনাখালী মুন্সী আঃ কাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম জানান,অডিট কর্মকর্তা আমাদের কোন হয়রানি করেনি।এছাড়া তাকে কোন ঘুষও দিতে হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারি শিক্ষক জানান,আমাদের স্কুল থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা অডিট কর্মকর্তাকে দেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষক নিয়েছে। স্কুলের সকল শিক্ষকদের কাছ থেকেই এ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অডিট কর্মকর্তা এ টাকা নিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক ২৫ হাজার টাকা ফিরিয়ে এনেছেন। ২ লাখ ২৫ হাজর টাকা দিতে হয়েছে।

আরেকজন সহকারি শিক্ষক জানান, শুনেছি নলী চরকগাছিয়া তমিজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে অডিট কর্মকর্তার তর্ক বিতর্ক হয়েছে। এখান থেকে এখনও টাকা দেয়নি। আমাদের হেড স্যার টাকা দিয়ে আসছেন। এটা মিনিস্ট্রি অডিট। এ টাকা নাকি দিতেই হবে। মঠবাড়িয়া থেকে এ বছর নাকি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা নিয়েছে।

এনটিআরসিএ’র সুপারিশপ্রাপ্ত একজন সহকারি শিক্ষক জানান,অডিট কর্মকর্তা আমাদের প্রতিষ্ঠানে এসে প্রথমে আমাদের কাগজপত্র দেখে আমাদের বাড়ি যেতে বলেন। এরপর কমিটির নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কাগজপত্র দেখেন। পরদিন প্রধান শিক্ষক অডিট কর্মকর্তাকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে অফিসে আলোচনা করেন। সকল শিক্ষকদের এক মাসের বেতন দিতে হয়েছে। প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের এক এমপিও নিয়ে ঢাকায় গিয়ে টাকা দিয়ে এসেছেন।

পিরোজপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ ইদ্রিস আলী আযিযী জানান,এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে হবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।

এ ব্যাপারে সহকারি শিক্ষা পরিদর্শক মোঃ শামীম আলী জানান, আমরা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নেইনি। যে কয়টি প্রতিষ্ঠান অডিট করা হয়েছে তার রিপোর্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হবে। অডিটের ক্ষেত্রে কোন তদবির বা সুপারিশ আমরা গ্রহন করিনা।