রিজার্ভ বাড়াতে আসছে অফশোর ব্যাংকিং

রিজার্ভ বৃদ্ধি, আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আসছে অফশোর ব্যাংকিং। এ জন্য ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন, ২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব মাহবুব হোসেন এসব তথ্য জানান।

সচিব বলেন, এই আইনের মাধ্যমে অনিবাসী ব্যক্তি বা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান যারা এখানে ইনভেস্ট করবে তারা অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। অফশোর ব্যাংকিং করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। যারা এই লাইসেন্স পেয়েছে তাদের নতুন করে আর লাইসেন্স নিতে হবে না। তিনি বলেন, ‘মার্কিন ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চায়নিজ ইয়ান—এই পাঁচ মুদ্রায় ব্যাংকিং কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে।

মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা হবে না। এই আইন তৈরি করা হচ্ছে শুধু দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ও আর্থিক কাঠামো সমৃদ্ধ করেছে। তারা বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট পেয়েছে।

বিদেশিরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যখন টাকা জমা রাখে তখন কিন্তু টাকা নিয়ে যেতে পারমিশন নিতে হয়। অফশোর ব্যাংকিং হলে স্বাধীনভাবে এটা অপারেট করা যাবে। এখানে ব্যবসা করে যারা লাভবান হবে, তারা এখানে টাকা রাখতে আগ্রহী হবে বলে আমরা আশা করছি। শুধু রিজার্ভ বাড়াতেই এটি করা হচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবে দেশ লাভবান হবে, সে জন্য এটি করা হচ্ছে।

সেভিং অ্যাকাউন্ট যেভাবে পরিচালনা করেন, সেভাবেই এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা যাবে। ওই অ্যাকাউন্টে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা জমা দেওয়া যাবে।’
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যে ব্যাংকিংব্যবস্থায় বৈদেশিক উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল সৃষ্টি হয় এবং প্রচলিত ব্যাংকিং আইনকানুনের বাইরে আলাদা আইনকানুনের মাধ্যমে এ তহবিল পরিচালিত হয় এবং হিসাব সংরক্ষণ করা হয়, তাকেই বলা হয় অফশোর ব্যাংকিং। অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরে আলাদা এক ব্যাংকিংব্যবস্থা। স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং, জাপানি ইয়েন, কানাডীয় ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলার, সুইস ফ্রাঁ ইত্যাদি বৈদেশিক মুদ্রায় অফশোর ব্যাংকিংয়ের হিসাব সংরক্ষণ করা হয়।

এসংক্রান্ত কোনো আইন না থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশে একভাবে অফশোর ব্যাংকিং চালু আছে ১৯৮৫ সাল থেকেই। দীর্ঘকাল পর ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর বেশ কয়েকটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। সূত্রগুলো জানায়, নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও এর ফাঁকফোকর গলে এরই মধ্যে সিঙ্গাপুর, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচারের মতো ঘটনা ঘটেছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালাটি যথাযথ না হওয়ায় এবং জবাবদিহির ঘাটতি থাকায় সরকার এ বিষয়ে আইন তৈরির পথে এগোচ্ছে। আইনটি সংসদে পাস হলে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) ও হাই-টেক পার্কগুলোতে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত সংগ্রহ করা সহজ হবে। আবার স্বল্প মেয়াদে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণও দেওয়া যাবে। এ ছাড়া ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও গ্যারান্টি সুবিধা; বিল বাট্টাকরণ (ডিসকাউন্টিং); বিল সমন্বয়করণ (নেগোশিয়েটিং) এবং অন্যান্য বৈদেশিক বাণিজ্যসম্পর্কিত বহির্লেনদেন সেবা দিতে পারবে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটগুলো। এমনকি তারা মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সুবিধাও দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদসচিব মাহবুব হোসেন বলেন, অফশোর ব্যাংকিং করতে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। বর্তমানে যেসব ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট পরিচালনা করছে, তাদের নতুন করে আবেদন করতে হবে না। এরপর অনিবাসী বাংলাদেশে বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত গ্রহণ করতে পারবে, ঋণ দিতে পারবে। ওই আমানত স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবেন। বিদেশে যে বাংলাদেশি আছেন তাঁর পক্ষে তাঁর কোনো আত্মীয় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন, সহায়তাকারী হিসেবে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঋণসীমা বেঁধে দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘ঋণসীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। যেকোনো পরিমাণ ঋণ নিতে পারবে।’

সমসাময়িক আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ১৯৮৫ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম ইপিজেডে শুরু হয়, সেখানে কিন্তু কারেন্ট অ্যাকাউন্টের মতো, কোনো ইন্টারেস্ট দেওয়া হয় না। এখন অফশোর ব্যাংকিংয়ে ইন্টারেস্ট দেওয়া হবে। ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে পারলে, ব্যাংকের স্বাভাবিক ব্যবসার প্রয়োজনে সে যখন বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তার তুলনায় ব্যয় কম হবে।