চুয়াডাঙ্গার মানুষের বেঁচে থাকার ভরসা দেবে কে? ভোক্তা অধিকার না-কী জেলা প্রশাসন

মূল্যস্ফীতির ধসে কঠিন দুঃসময়ের মধ্যেদিয়ে পার হচ্ছে একেকটা দিন। সে খেয়াল কী আছে কারো? অথচ রাজনীতির ভাষায় জনগণের জীবনযাত্রার মান অনুকূলে রাখার প্রধান দায়িত্ব রয়েছে সকল রাজনীতিবিদদের। সেখানে সব দায় এড়িয়ে নিজেদের ভালো থাকার স্বার্থে ব্যস্তসময় পার করছে তারা। জাতির ভোট নেয়ার কথা ঠিক মনে থাকলেও জাতির সুখ দেয়ার কথা মনে থাকে না কারো। খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজার। অথচ সেই বাজারে এখন ব্যবসায়ীদের অরাজকতা।

মূল কারণ হিসেবে যেটা উত্থাপিত হয়েছে। সেটা হচ্ছে আয়-ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যতা না থাকায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় জীবনযাত্রার শূন্য আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এদিকে, বর্তমানে শীতকালীন আগাম সবজির মৌসুম শুরু হওয়ায় জেলার বিভিন্ন অ লের মাঠ থেকে কাঁচা সবজি আসছে চুয়াডাঙ্গার বড়বাজার, রেলবাজার, কেদারগঞ্জ বাজারে। আমরা সবাই বরাবরই দেখেছি। শীতকালীন সবজির দাম ক্রেতাদের হাতের নাগালে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে জেলার ভালাইপুর গাড়াবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপারীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে ১০-১২ টাকায় শীতকালীন সবজি কিনলেও বাজারে ভোক্তাপর্যায়ে তা তিনগুণে দাঁড়াচ্ছে সবজির দাম। এতে করে ক্রেতারা বাজার করতে এসে স্বাভাবিক চাহিদামতো পণ্য কিনতে পারছে না। উচ্চমূল্যের ভারে ফুরিয়ে যাচ্ছে পকেটের সব টাকা। যা আয়ের থেকে স্বাভাবিক ব্যয় বেশি হওয়ায় হতাশায় জর্জড়িত সাধারণ মানুষ।

অবৈধভাবে মুনফা অর্জনের আশায় ব্যবসায়ীক অঙ্গনে যে সিÐিকেট তৈরী হয়েছে তা ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। কৃষির বেশিরভাগ ফসল সব ধরনের শাকসবজি চুয়াডাঙ্গাতেই উৎপাদন হয়ে থাকে। তবুও সিন্ডিকেট ব্যাপারী, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কারণে ভোক্তাপর্যায়ে শাকসবজির উচ্চমূল্যের কাছে অসহায় পড়েছে মানুষ।
এদিকে, কৃষক সর্বোচ্চ কষ্ট করে ফসল পণ্য উৎপাদনে কষ্টের ফল ভোগ করছে প্রকৃতপক্ষে সিন্ডিকেটধারী ব্যাপারী ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা।

তারা কৃষকদের কাছ থেকে যে সবজি ১০-১২ টাকা দরে কিনছে সেই সবজি বাজারে প্রতি কেজি ফুলকপি ২২ টাকা, বাঁধাকপি ২৫ টাকা, মূলা ২০ টাকা, টমেটো মানভেদে ৮০ টাকা, শিম ৩০-৩৫ টাকা, ধনেপাতা ৫০ টাকা, দেশি কাঁচামরিচ ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। কেজি দরে বিক্রি করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা।

অপরদিকে, বাজার প্রতিবেদনে দেখা গেছে একমাত্র সিন্ডিকেটধারী ব্যাপারী আর পাইকারী ব্যাপারীদের কারণেই কৃষক কষ্টের বিফল ও ভোক্তাগণের অভাবের সংসার উপহার দিচ্ছে তারা। আয়-ব্যয়ের বেড়াজালে সংসার জীবনের স্বাভাবিক খরচ মেটাতেই বিনা পানিতেই হাবুডুবু খেতে হচ্ছে মানুষের। যার প্রভাবে বয়স বাড়ার আগেই কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে স্বল্প আয়ের মানুষের।

দামুড়হুদার রামনগর-কলাবাড়ীর চাষী আব্দুস সাত্তার বলেন, হরতাল-অবরোধের অজুহাত দেখিয়ে ব্যাপারীরও আমাদের ঠকাচ্ছে। কিন্তু এখন সবজি তোলার সময় হয়েছে, তাই বাধ্য হয়েই কম দামে তাদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুর বাজারের সবজির আড়ৎ ঘুরে জানা গেছে, এই মোকামে শীতকালীন সবজির মধ্যে ফুলকপি ও বাঁধাকপির আমদানি ছিল চোখে পড়ার মতো।

সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের সবজি চাষী মুকুল হোসেন বলেন, এবার বিঘাপ্রতি সবজি চাষে খরচ হয়েছে ২০-২৫ হাজার টাকা। এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ। প্রতি গাড়িতে এখন ৮-১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় সবজি বিক্রি করে দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
বিভিন্ন মাঠের চাষীরা বলছে, আমরা এই শীতে ভোর থেকে মাঠে কষ্ট করে সবজি চাষ করে থাকি। অথচ ব্যাপারীরা সিন্ডিকেট করে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম দিতে চায় না। ফলে উৎপাদন ভালো হলেও কোনো রকম আসল টাকা উঠে আসলেও লাভের অংশ আমরা খুঁজে পাই না।

বিভিন্ন প্রান্তের ব্যাপারী বলছে, বিএনপির ডাকা অবরোধ আর হরতালের কারণ দেখিয়ে এবং জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় তারা সবজির দাম দিচ্ছে না। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম অনেক আগে থেকেই বৃদ্ধি রয়েছে। অথচ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা চাষীদেরকে যেমন ঠকাচ্ছে তেমনী পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের দখল থেকে ভোক্তারা তিনগুণ দামে কিনতে হচ্ছে শীতকালীন বিভিন্ন সবজি।

এদিকে পাইকারীরা বলছে, তারা ব্যাপারীদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই আমরাও বেশি দামে বিক্রি করছি।
যার দরুণ গরীব-নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের পরিবারে সংসার চালিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করানোও দায় হয়ে পড়েছে বাড়ির কর্তাদের। তবে বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অবৈধ অভ্যাসে পরিণত হলেও তা এখন বৈধ হিসেবে চলমান রেখেছে ব্যবসায়ীরা। একমাত্র এই বাজার সিন্ডিকেটের কারণে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকায় এখন দায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের। এই মুহূর্তে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়। তাহলে ভবিষ্যতে জাতির জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী চিত্র আঁকাতে পারেনি বাজার মনিটরিং সংশ্লিষ্টরা। তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কারা?

গরীব-নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের দুঃখ কষ্ট বোঝার ক্ষমতাও যেন হারিয়েছে সরকার। ধনীদের আয়ের হিসাব স্বল্পআয়ের মানুষের হিসাবে যুক্ত করে বিশাল অঙ্কের মাথাপিছু আয় দেখিয়ে নিজেকে দায়মুক্তও ভাবে সরকার। এটা কখনই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হতে পারে না। তবে দেশে উন্নয়নের মাইলফলক খুললেও মানুষের সহজ জীবন আজ কঠিন হয়ে পড়েছে। যা জীবনযাত্রার মান ঠিক রেখে উন্নয়ন করাই ছিল দায়িত্বশীল সরকারের কাজ। দিন যায় মাস যায় বছরের পর বছর গেলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। আর সে কারণে ভোক্তা অধিকারসহ জেলা প্রশাসনের একাধিক টিমের কৌশলী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন জেলার সচেতন ব্যক্তিরা।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি নির্ভর জেলা হওয়ায় এখানকার সকল কৃষিপণ্যের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বাজারজাত করার সুনাম আগে থেকেই রয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সহিদুল ইসলাম বলেন, এ জেলার সবজি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৩০ শতাংশ সবজির চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এবার কিছুটা নিচে নেমেছে। যদিও বলা হচ্ছে সবজিবাহী গাড়ি হরতাল-অবরোধমুক্ত। তবুও কিছু শঙ্কা তো থেকেই যায়। আমরাও কৃষকদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করছি।

এবারও সবজির বাম্পার ফলন হলেও ব্যবসায়নীতি নষ্ট করে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে সুখের জীবনে ফিরতে পারছেনা সাধারণ মানুষ।
আগে জেলার মানুষ যে সকল শীতকালীন সবজি শীতকালেই খেয়ে থাকতো-আধুনিক প্রযুক্তির কারণে সেইসব সবজি এখন বারোমাসাই উৎপাদন হয়। তারপরও সবজি উৎপাদনে কোনো ঘাটতি না থাকলেও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায় ভোক্তা সাধারণ।
দিন যতই যাচ্ছে ব্যবসায়ীনীতি ভঙ্গ করে বাজারে সকল দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি দাম চলমান থাকায় গরীব নিন্ম ও মধ্যবিত্তরা আস্তে আস্তে দুর্ভিক্ষের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।

যদি এই মুহূর্তে ২০২০ সালের শুরুর অনুরূপ বাজারে ফিরিয়ে আনা না হয় তাহলে যুদ্ধ বিধ্বস্তের মতো আকার ধারণ করতে পারে মানুষের জীবনযাত্রা।

তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি না দেয়ায় বাজার অনিয়ন্ত্রিত থেকেই যাচ্ছে বারোমাস। ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ জেলায় বিশেষ করে গরীবের খাদ্য চাল, ডাল, আলু, বেগুন, কাঁচকলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, লাউ, শসাসহ এমন কোনো কাঁচা তরকারি নেই যে সাধারণ মানুষ ক্রয় করতে পারে। তবে ভোক্তারা এ বিষয়ে দুষছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে। ভোক্তারা বলছে, বাজারে সংশ্লিষ্টদের অভিযান অব্যহত না থাকাসহ কঠোর শাস্তির বিধানে না আনতে পারায় জিনিসপত্রের দাম কোনোভাবেই কমছে না।

সংশ্লিষ্টরা অভিযান চালিয়ে চলে গেলেই আবারও তাদের বৃদ্ধিকৃত দামে ফিরে যায় বলেও জানিয়েছে ক্রেতারা। তাই সকল নিত্যপণ্যের সরকারী দাম নির্ধারণ করে বাজারের প্রধান প্রধান জায়গায় বিলবোর্ড বা ব্যানার স্থাপন করার কৌশলগত দিক অবলম্বনে বাজার নিয়ন্ত্রণসহ হতে পারে ভোক্তাদের স্বস্তির অন্যতম পথ।
শুধু তাই-ই নয় ভোক্তা অধিকারসহ জেলা প্রশাসনের মোবাইল নম্বর উল্লেখ করে অভিযোগের জায়গা তৈরী করা।

যাতে করে সরকারী মূল্যের চেয়ে বেশি দাম নিলেই মোবাইলফোনে অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোকানে সিলগালা-জরিমানা করতে হবে। তবে ভোক্তাগণকে সবার আগে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রতিবাদী হতে হবে। যাতে করে সরকারী মূল্যের বেশি দাম নিলেই বাজারে অবস্থানকালীন ভোক্তা অধিকারে মোবাইলফোনে অভিযোগ করার প্রচলন তৈরি করলে ভবিষ্যতে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেমন ব্যবসায়ীনীতিতে ফিরে আসবে তেমনী ভোক্তাদের স্বস্তির পথ আলোকিত হবে।

কিন্তু এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামতে হবে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনসহ বাজার মনিটরিং সংশ্লিষ্টদের।

বাজারে আসা এক ক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা কোনোদিন টিসিবির পণ্য কিনিনি। এখন আমাদের টিসিবি পণ্য কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মহাভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আমাদের লজ্জা লাগে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে টিসিবি পণ্য দিয়ে আমাদেরকে সমাজে ছোট করে রেখেছে।

এ বিষয়ে রোমানা আক্তার বলেন, আমার স্বামী ২০ হাজার টাকা বেতনে একটা চাকরী করে। যা বেতন পায় তা দিয়ে ২০২০ সালেও আমরা সংসার স্বাভাবিকভাবে চালিয়েছি। এখন আয় বাড়েনি কিন্তু জিনিসপত্রের দাম এত বৃদ্ধি হয়েছে যা তিন বেলা সঠিকভাবে খাবার খাওয়ার উপায় নেই। যদি এখনই ২০২০ সালের অনুরূপ বাজারে ফিরিয়ে আনা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে, সচেতন মানুষ বলছে অন্য কথা। তাদের অনেকেই বলছে, সার ডিজেলের দাম অনেক আগে বেড়েছে আর সে সুযোগ এখনও কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।

জেলা কৃষি কর্মকর্তা বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, চুয়াডাঙ্গার সবজিতে বিশেষ খ্যাতি থাকায় চাহিদা অনেক বেশি। তাই চাষাবাদও হয় প্রচুর। শীত মৌসুম জুড়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার সবজি পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন জেলাতে।

একটু লাভের আশায় বছরের এই সময়ে শীতের সবজি আবাদ করে থাকে প্রান্তিক চাষিরা। বাজারে সবজীর দাম বাড়লেও লোকসানে ডুবে থাকে কৃষক আর মূল্যবৃদ্ধির কারণে বারোমাসই অভাব কাটেনা সাধারণ মানুষের।