সরকারের করের ফাঁদ ও আইন জটিলতায় পড়েছে চুয়াডাঙ্গার মানুষ

দীর্ঘদিন ধরে অর্থ সঙ্কটসহ নানা জটিলতায় অব্যহত রয়েছে দেশ। এমন চলমান অবস্থার মধ্যদিয়ে নিত্যপণ্যসহ সকল দ্রব্যের সীমাহীন দামে জনজীবনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

এরমধ্যে চুয়াডাঙ্গায় প্রায় ৬ মাসের মতো বন্ধ হয়ে পড়েছে জমি রেজিস্ট্রীর কার্যক্রম। একসময় যে রেজিস্ট্রী অফিসের দিকে তাকালেই মনে হতো যেন পান/মাছের হাট বসেছে। যার বেশিরভাগ সময়ই এমন অবস্থায় থেকেছে সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদাসহ জীবননগর সাব রেজিস্ট্রী অফিসগুলো। এমনকি প্রথম ধাপের করোনার মহাসঙ্কট সময়ের মধ্যেও বন্ধ থাকেনি জমি রেজিস্ট্রীর কার্যক্রম। এতে করে সরকার প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছে চুয়াডাঙ্গা থেকে। যে আয় দিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে সরকার এবং সুষ্ঠুভাবে জমি বেচাকেনা করেছে ক্রেতা—বিক্রেতারাও। এতে করে জমি ক্রেতা—বিক্রেতারা তাদের পারিবারিক ব্যবসায়ীক সন্তানদের বিয়েসাধিসহ বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে তারা। বর্তমানে সরকারের করের ফাঁদ আর জমি রেজিস্ট্রী আইন—কানুন কঠিন শর্ত আরোপ করায় বন্ধের পথে চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুাসহ জীবননগরে জমি রেজিস্ট্রীর কার্যক্রম। ফলে চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত রয়েছে সরকার। যে কারণে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ভাটা পড়াসহ অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে।

এ বিষয়ে দলিল লেখক সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা চার উপজেলায় প্রায় ১ হাজারের মত দলিল লেখক রয়েছে। সেই হিসেবে প্রতিটি সাব রেজিস্ট্রী অফিসে প্রতিমাসে আনুমানিক ৪শ’র মত দলিল রেজিস্ট্রী হয়েছে। সেই মোতাবেক সরকার যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করেছে তেমনী ক্রেতা—বিক্রেতারাও স্বাভাবিকভাবে জমি কেনাবেচা করে তাদের নানা সঙ্কট দূর করতে পেরেছে। বর্তমানে সরকার নতুন করে করের ফাঁদে আটকিয়ে ফেলেছে জমি ক্রেতা—বিক্রেতাকে।

বর্তমানে মৌজা মূল্য অনুযায়ী জমির মূল্য হিসেবে পৌর এলাকায় প্রতি লাখে ৩ হাজার এর পরিবর্তে ৬ হাজার এবং ইউনিয়নপর্যায়ে ১ হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। আর সে কারণেই চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদাসহ জীবননগর সাব রেজিস্ট্রী অফিসে দলিল রেজিস্ট্রীর কার্যক্রম প্রায় বন্ধের পথে।

রেজিস্ট্রী অফিসগুলো খোলা থাকলেও নেই তেমন কোনো কার্যক্রম। প্রতিটি সাব রেজিস্ট্রী অফিসে সপ্তাহে ৩/৪শ’ টি দলিল রেজিস্ট্রী হলেও বর্তমানে ৩০/৪০টি দলিল রেজিস্ট্রীই যেন ভাগ্যের ওপর নির্ভর হয়ে গেছে। যা আগের তুলনায় চারভাগের তিনভাগই বন্ধ হয়ে খঁুড়িয়ে খঁুড়িয়ে চলছে রেজিস্ট্রী কার্যক্রম। এতে করে প্রতি মাসে আগে চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করলেও এখন ওইপরিমাণ টাকার প্রায় একভাগে নেমে এসেছে। ফলে দেশের উন্নয়নকাজে ভাটা পড়াসহ ছিন্নমূল মানুষের ভর্তুকি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে।

এদিকে, বিভিন্ন অফিসের দলিল লেখকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৮০ ভাগই বিক্রেতারাই পিতার ওয়ারিশ সূত্রে জমি বিক্রয় কবালা, হিবার ঘোষণা, দানপত্রসহ বিভিন্ন দলিল যুগ যুগ ধরেই রেজিস্ট্রী হয়ে আসছে। বর্তমানে নতুন আইনে সরকার ডাবল করের ফাঁদে ফেলেছে। সেইসাথে জমি বিক্রি করতে হলে পিতার ওয়ারিশ সূত্রে কেউ জমি বিক্রি করতে পারবে না। যদি বিক্রি করতে হয় তাহলে তাকে বন্টননামা করে তা আবার নাম খারিজ করতে হবে। তারপর একজন ব্যক্তি জমি বিক্রি করতে পারবে। এমন কঠিন শর্তের আইন বাস্তবায়ন করায় চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলায়ই রেজিস্ট্রী কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে।

এ নতুন আইন চালু হওয়ায় গ্যাড়াকলে পড়েছে জমি ক্রেতা—বিক্রেতারা। সরকারও বঞ্চিত হয়ে পড়েছে রাজস্ব আয় থেকে। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে দেশের উন্নয়ন কাজে।
চুয়াডাঙ্গা সদর সাব রেজিস্ট্রী অফিসে এসে সরকারের করের ফাঁদ আর জমি বিক্রির নতুন আইনের কথা শুনে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে ক্রেতা—বিক্রেতাদের। এতে করে দুর্ভোগ নিয়েই দিন পার করছে জমি ক্রেতা—বিক্রেতারা। সেইসাথে দলিল লেখকরা পড়েছে বিপাকে। জমি রেজিস্ট্রী কমে যাওয়ায় তাদের অনেক পরিবারে নেমে এসেছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।

এ বিষয়ে রাহেন উদ্দিন নামের এক জমি বিক্রেতা বলেন, আমি এর আগে পিতার ওয়ারিশ সূত্রে জমি বিক্রি করেছি। বর্তমানে পিতার ওয়ারিশ সূত্রে জমি বিক্রি করতে পারছি না। এসে শুনি আগে পৌর এলাকার জমি রেজিস্ট্রী খরচ লাখে ভ্যাট ছিল ৩ হাজার টাকা তা বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার টাকা। এতে করে ক্রেতারাও পড়েছে বিপাকে। জমি রেজিস্ট্রীতে বেশির ভাগই বিক্রেতাদের ভ্যাট ক্রেতাদের মধ্যে ফেলে দেয়। তা দিতে গিয়ে এখন ক্রেতারাও পড়েছে বিপাকে। এতে জমি কেনাবেচা এখন গোলক ধাধায় পরিণত হয়েছে।

এদিকে, হীরা খাতুন নামের এক জমি বিক্রেতা বলেন, মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা লাগবে। তাই জমি বিক্রি করতে এসেছিলাম। নতুন আইনে রেজিস্ট্রীর খরচ যেমন ডাবল বাড়িয়েছে তেমনী পিতার ওয়ারিশ সূত্রে জমি বিক্রি করাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি নওশের আলী বলেন, এ অফিসের মধ্যে ২শ’ মত দলিল লেখক রয়েছে। তারমধ্যে হাতেগোনা ৪০/৫০ জনের বেশি দলিল করে থাকে। তারমধ্যে আমার সেরেস্তায় দলিল বেশি হতো। কিন্তু সরকারের জমি বিক্রি পৌর ভ্যাট ৩ হাজারের পরিবর্তে ৬ হাজার এবং ইউনিয়নপর্যায়ে ১ হাজারের পরিবর্তে ২ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়াও পিতার ওয়ারিশ সূত্রে দলিল রেজিস্ট্রী বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। সে কারণে রেজিস্ট্রী অফিস বন্ধের মত অবস্থা তৈরী হয়েছে। এতে জমি ক্রেতা—বিক্রেতারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনী সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় সরকার যদি এমন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে তাহলে রেজিস্ট্রী অফিস অচিরেই পুরোপুরি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে নাসির উদ্দিন নামের এক দলিল লেখক বলেন, আমি আগে সপ্তাহে ৮/১০টা করে দলিল রেজিস্ট্রী করতাম। সরকার রেজিস্ট্রী খরচসহ সরকার পিতার ওয়ারিশ সূত্রে জমি বিক্রি বন্ধ করে দেয়ায় জমি রেজিস্ট্রী প্রায় বন্ধের পথে। এতে আমরা অফিসে এসে বসে থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। তবে সরকার যদি পূর্বের আইনে ফিরে না যায় তাহলে আগামীতে রেজিস্ট্রী অফিসগুলোর বেহাল দশা তৈরী হবে। সরকারও বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।

এদিকে, জমি ক্রেতা—বিক্রেতাদের অনেকেই বলেছে, সরকার যদি খরচ কমিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে না যায় তাহলে সরকার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনী জমি ক্রেতা—বিক্রেতারাও তাদের ব্যবসায়ীক কার্যক্রমসহ সাংসারিকভাবে সন্তানদের লেখাপড়া বিয়েসাধীসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে ক্ষতিসাধিত হবে।
অপরদিকে, জমি রেজিস্ট্রীর এ সঙ্কট দ্রুত সমাধান না করলে অচিরেই ভেঙে পড়বে জমি রেজিস্ট্রীর কার্যক্রম। যার কারণে দেশ ও জাতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।