তেঁতুলিয়ায় ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বি.এম কলেজে জালিয়াতির মাধ্যমে পাঁচ শিক্ষক তালিকাভুক্ত

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের মালিগছ গ্রামে অবস্থিত এমপিওভুক্ত ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে তৎকালীন সভাপতির স্বাক্ষর ও সীল জালজালিয়াতির মাধ্যমে ৫ শিক্ষক নিয়োগ দেখানো হয়েছে। এই জালজালিয়াতির তৈরিকৃত পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন অত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও কমিটির সদস্য সচিব আবু সুফিয়ান। এতে এলাকায় চাঞ্চল্যকর প্রভাব বিস্তার করেছে।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়োগ দেখানো শিক্ষকরা হলেন- বাংলা বিষয়ের প্রভাষক বিমল কুমার রায়, কম্পিউটার আপারেশন বিষয়ের প্রভাষক সফিকুল আলম, সাচিবিকবিদ্যা বিষয়ের প্রভাষক দিলিয়ারা বেগম, ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রভাষক দিলারা বেগম এবং নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক/কম্পিউটার অপারেটর উম্মে বিনতে সালমা।

জানা যায়, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হওয়ার পর গত ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখে কমিটির রেজুলেশনের মাধ্যমে ৯জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আহবান করা হয় এবং ২০০৬ সালের জুন মাসের ২৫ তারিখ ৯জন শিক্ষক-কর্মচারীকে অনুমোদন দেয়া হয়। পরে ওই সালের জুন মাসের ২৮ তারিখে অধ্যক্ষ এবং পরের দিন ২৯ তারিখে ৮জন শিক্ষক-কর্মচারী যোগদান করেন। এরপর গত ২৩ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে দীর্ঘ ৯বছর পর দুই হাজার ৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) ভুক্ত করা হয়। এরই ধারবাহিকতায় উপজেলার ওই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিও ভুক্ত করেন সরকার।

আরোও জানা যায়, প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও করণের লক্ষ্যে গত ২০২০ সালের মে মাসের ৩১ তারিখের ভিটিবিএমসি/২০২০/৩০ নং স্বারকে ৯জনের নাম পদবী ও বেতন উল্লেখ করে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে একটি আবেদন করেন। এদের মধ্যে অধ্যক্ষ ১জন, ডেমোনেষ্টেটর কাম মেকানিক ২জন, সহকারী লাইব্রেরীয়ান ১জন, অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী ১জন, কম্পিউটার ল্যাব এসিসটেন্ট ১জন, টাইপিং ল্যাব সহকারী ১জন, গার্ড কাম এমএলএসএস ১জন এবং এমএলএসএস(নৈশ্যপ্রহরী) ১জন।

প্রতিষ্ঠান প্রধান গত ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখের ৫৭.০৩.০০০০.০৯১.২০.০০৭.২০-৩১৭ নং স্বারকের সূত্রমতে গত ২০২০ সালের মে মাসের ৩১ তারিখের ভিটিবিএমসি/২০২০/৩০ নং স্বারকে মহাপরিচালক, বালাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবরে যে ৯জন শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং কর্মচারীর এমপিও করণের আবেদন পাঠান তাহার ওই এমপিও ভুক্তির পাঠানো আবেদনের তথ্যের প্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর গত ২০২০ সালের জুলাই মাসের ২৬ তারিখের ৫৭.০৩.০০০০.০২৮.১৮.০১১.১৮-৫৭৭ নং স্বারকের পত্রের আদেশে শিক্ষা-কর্মচারীদের আবেদন সমূহে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ (১৯ জুলাই ২০১৮) অনুযায়ী কাগজ-পত্রাদি অসম্পূর্ণ/ত্রুটিপূর্ণ/সমস্যাযুক্ত থাকায় এ পর্যায়ে সংযুক্ত তালিকা ‘ক’ তে বর্ণিত ৫০৪জন আবেদনকারীর এমপিও বিবেচনা করা হয়নি। এই বিবেচনাহীন তালিকায় ধরা পড়েন উপজেলার ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বি.এম কলেজের এমপিও ভুক্তির জন্য প্রেরিত সকল শিক্ষক ও কর্মচারীগণ। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পত্রের প্রেরিত আদেশে উক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদিত পত্রের প্রেক্ষিতে সকলের উঠে আসে জালজালিয়াতি আর অনিয়মের কথা। পরে অসম্পূর্ণ/ত্রুটিপূর্ণ/সমস্যাযুক্ত কাগজ-পত্রাদি সংশোধন করে ৪জনের এমপিও পেয়েছেন প্রতিষ্ঠান।
এদিকে ৯জন শিক্ষক-কর্মচারীর ঝড়ঝান্ডা শেষ হতে না হতেই প্রতিষ্ঠান প্রধান আবু সুফিয়ান গত ২০০৬ সালের জুন মাসের ৩০ তারিখে কমিটির রেজুলেশনের মাধ্যমে ৫জনের নিয়োগ প্রক্রিযা তৈরি করেন এবং গত ২০০৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখে ৫জনের নিয়োগটি অনুমোদন করেন। অথচ আগের নিয়োগকৃত শিক্ষকদের নামের তালিকা গত ২০২০ সালের মে মাসের ৩১ তারিখের ভিটিবিএমসি/২০২০/৩০ নং স্বারকে এবং গত ২০২০ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ অত্র প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর নিকট প্রেরিত তালিকায় ওই ৫জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এরপর চলতি বছরের গত মাসের ৫ তারিখ প্রতিষ্ঠান প্রধান ১৬ জনের নামের তালিকা সভাপতি ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বি.এম কলেজ ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর নিকট উপস্থাপন করলে রেজুলেশন গুলো খতিয়ে দেখার পর সীল ও স্বাক্ষর অমিল এবং কতিপয় ব্যক্তির বক্তব্যের ভিত্তিতে ফাইলটি সন্দেহের মধ্যে রয়েছে।

সরে জমিনে গিয়ে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, নতুন করে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে কেউ বলতে পারছেন না। আগ থেকে ৯জন শিক্ষক-কর্মচারী ওই প্রতিষ্ঠানে আছে অনেকেই জানিয়েছেন।

অত্র প্রতিষ্ঠান কমিটির অভিভাবক সদস্য আব্দুর রাজ্জাক প্রধান ও রফিকুল ইসলাম জানান, ২০০৬ সালে ৯জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর পর কোনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদি নিয়োগ দিয়ে থাকে, তবে কখন কাকে নিয়োগ দিয়েছে তা তাঁরা বলতে পারছেন না। এদিকে এনটিআরসি কর্তৃক দু’জন শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছে সে বিষয়ে তাঁরা অবগত আছেন। রফিকুল আরোও বলেন, তাদের সঙ্গে ঠিকমতো কোনো মিটিং করা হয়না।
প্রতিষ্ঠানের গার্ড কাম এলএমএসএস মোস্তফা কামাল বলেন, তিনি জন্মলগ্ন থেকেই ওই প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন এবং জমিও দান করেছেন। তাঁর নিয়োগের সময় ৯জন ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর পরে কোনো শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদি কোনো শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে তাহলে সে বিষয়ে প্রেন্সিপাল বুঝবেন। তবে তিনি ৫জন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে কিছুই জানেন না। এদিকে মুঠোফোনে ডেমোনেষ্টেটর কাম মেকানিক শাহিন শাহ বলেন, তিনি ৯জনের বিষয়ে অবগত আছেন আর কিছুই বলতে পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের আরেক শিক্ষক বলেন, নতুন করে যে ৫জন শিক্ষক নিয়োগ দেখানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ জালজালিয়াতি আর টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের দাতা সদস্য এমদাদুল হক বলেন, বিষয়টি অনেক আগের তা কি এখন খেয়াল আছে? প্রতিষ্ঠানে যতগুলো শিক্ষক-কর্মচারী দরকার তা আমরা নিয়োগ দিয়েছি। আপনারা যে ৫জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন সেই ৫জনের নামের তালিকা ২০২০ সালের দিকে অত্র প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে সংযুক্ত করেন নাই এবং এমপিও ভুক্তির আবেদনেও সংযুক্ত করেন নাই? এমন প্রশ্নে কোনো সদুত্তোর না দিয়ে প্রেন্সিপালের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।

ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বি.এম কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান মুঠোফোনে জানান, যখন যে কয়েকজনের নামের তালিকা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে সেই নামের তালিকা উপজেলায় দিয়েছেন। তিনি ৯জনের নাম গুলো আগে পাঠিয়েছেন আর পরের গুলো পরে পাঠিয়েছেন। আপনি ১মাসের ব্যবধানে নিয়োগকৃত ৫জনের নামের তালিকা উপজেলা নির্বাহী অফিসে এবং কারিগরি অধিদপ্তরের সংযুক্ত করলেন না কেন? এমন প্রশ্নে কোনো সদুত্তোর না দিয়ে বলেন, ভাই এতদিন পর ৪জনের বিল হয়েছে এতে এতকিছু করার দরকার আছে। এরপর শিক্ষক নিয়োগের এক মাস আগপাছ রেজুলেশনে স্বাক্ষর ও সীলের অমিল দেখা দিয়েছে জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, হইতো ফটোকপির জন্যই এমন লাগছে। পরিশেষে তিনি গত ২০০৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখের ৫জনের অনুমোদিত নিয়োগ সঠিক বলে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে সাবেক সভাপতি ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দিনাজপুর সোহাগ চন্দ্র সাহার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে ৯জন শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন আমার মনে হয় তবে দেখতে হবে। বর্তমানে যিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে আছেন তিনিই এ বিষয়টি সঠিকভাবে দেখবেন।

এ ব্যাপারে সভাপতি ভজনপুর নগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) ফজলে রাব্বি বলেন, আমার কাছে প্রদর্শিত ১৬জন শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকার মধ্যে ৫জনের নিয়োগ বিষয়ে কোনো কিছুই জানিনা। কখন কিভাবে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অত্র প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ রেজুলেশন প্রক্রিযাগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। এই বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।